সবকিছু নাগালের বাইরে
প্রতীকী ছবি
চাল, চিনি, সয়াবিন তেল, ডিম, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে নির্মাণ সামগ্রী রড, সিমেন্ট, টাইলস এমনকি পোশাকের দামও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। আর দেশে লোডশেডিংয়ের কারণে চার্জার লাইট ও ফ্যানের দামও দ্বিগুণ।
এসব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে নানা অজুহাতে। কখনো বলা হচ্ছে পণ্যের উৎপাদন কম, কখনো আবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত।
নিয়ন্ত্রণহীন নিত্যপণ্যের বাজারে সবচেয়ে বেশি অসহায় দরিদ্র, স্বল্প আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্তরা। নিত্যপণ্যের খরচ বাড়লেও বাড়েনি আয়। কিন্তু বাজারের পাগলা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর, সংস্থার তদারকি খুব একটা নেই। মাঝেমধ্যে সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারে অভিযানে গিয়ে জেল-জরিমানা করলেও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বাজারের এই ঊর্ধ্বগতি থামাতে না পারলে শুধু পকেটই কাটা যাবে সাধারণ মানুষের। এমনটাই মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
বাজারের নৈরাজ্য দেখে খোদ শীর্ষ ব্যবসায়ীরাও বিরক্ত। তারা বলছেন, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের জন্য বাজারকে অস্থির করে তুলছে। তারা বলছেন, মুনাফালোভীদের দায়ভার ভালো ব্যবসায়ীরা নেবে না।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, ‘আসলে ডলারের প্রভাব বাজারে পড়েছে। কিন্তু কোনো পণ্যের দাম ৫০ পয়সা বাড়লে বিক্রেতারা ২ থেকে ৫ টাকার বেশি দাম নিচ্ছে। ৩ টাকা বাড়লে ১০ টাকা বেশি নিচ্ছে। তারা ফাজলামি করছে। তারা মনে করছে সামনে আরও মন্দা আসতে পারে, ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে। এ জন্য বেশি দাম নিচ্ছে। নিজেদের পুঁজি স্ট্রং করে নিচ্ছে। এফবিসিসিআই থেকে তাদের বারবার বলা হচ্ছে এটা ঠিক না। অনৈতিক কাজ। এর দায়ভার কেউ নেবে না।‘
তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি চালের বাজার অস্থিতিশীলের বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে মিলমালিক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ডাকা হয়েছিল। তাদের সর্তক করা হয়েছে। একইভাবে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি হলে মিলমালিক থেকে শুরু করে সব ব্যবসায়ীদের ডাকা হয়েছিল। সাবধান করা হয়েছে। রড সিমেন্ট থেকে শুরু করে সব সেক্টরের ব্যবসায়ীদের বলা হচ্ছে কেউ যাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি না করে। এফবিসিসিআই থেকে বাজার মনিটরিং সেলও করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন খাতের অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বার নেতাদের সঙ্গে সভা-সমাবেশ করে সবাইকে সর্তক করা হচ্ছে।’
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক তাহমিনা বেগম জানান, ‘রবিবারও (১৪ আগস্ট) রাজধানীর নিউমার্কেট, কাপ্তান বাজারসহ সারাদেশে বিভিন্ন বাজার ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ভোক্তা-স্বার্থ বিরোধী অপরাধে ৮৪টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ছয় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘সব জায়গায় গলদ। হাত বাড়ালেই তা ধরা পড়ছে। ভোক্তাদের স্বার্থে প্রতিনিয়ত রাজধানীসহ সারাদেশে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ভোক্তাদের স্বার্থ বিরোধী কিছু পাওয়া গেলে তা ধরা হচ্ছে। সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে বাজার মনিটরিং এর মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও বর্তমানে অস্থির সময় পার করছে। তাই আমরা যতই চেষ্টা করি পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন কাজ।’
গরিবের আমিষ হিসেবে পরিচিত ফার্মের মুরগির কেজি ছিল ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা। সেই মুরগির কেজি এখন ২০০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, দ্রব্যমূল্য লাগামহীন হয়ে গেছে। অনেকে গরু, খাসির মাংস কিনতে পারছে না। দেশি মুরগিও কিনতে পারছে না। বাধ্য হয়ে তারা সস্তা পোল্ট্রি মুরগি খাচ্ছে। এ জন্য হঠাৎ করে কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে গেছে।
মোহাম্মদপুর টাউনহল কাঁচাবাজারের মুরগি ব্যবসায়ী সোহান ঢাকাপ্রকাশ’কে জানান, ‘পাকিস্তানি মুরগি, গরু, খাসি মাংসের দাম একেবারে লাগামহীন। বাধ্য হয়ে অনেকে সস্তা পেয়ে পোল্ট্রি মুরগি খাওয়া শুরু করেছে। এ জন্য ১৫০-১৫৫ টাকার এই মুরগি ২০০ টাকা কেজি হয়ে গেছে। বেশি দামে কেনা। তাই বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। তার বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া একই বাজারের জহির মাংস দোকানের সাহিদ ও জনপ্রিয় মাংস বিতানের সিরাজের বক্তব্যেও। তারা ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, ‘সব কিছুর দাম বাড়লেও গরু ও খাসির মাংসের দাম কম। আগের ১০০০ টাকার খাসির মাংস ৯০০ টাকা ও ৭০০ টাকা গরুর মাংস ৬০০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। তারপরও বিক্রি কমে গেছে। কারণ কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ‘আসলে মানুষের ক্রম ক্ষমতা কমে গেছে। তাই বাজারে ক্রেতা কম, বিক্রিও কম হচ্ছে।’
সরকার শুল্ক সুবিধা দিলেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে চালের বাজারও অস্থির হয়ে গেছে। পরিবহন খরচ কেজি প্রতি ৫০ পয়সা না হলেও কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেশি দামে চাল বিক্রি করছে খুচরা ব্যবসায়ীরা।
মোহাম্মদপুর কৃষিমার্কেটের সাপলা রাইস এজেন্সির শিপন বলেন, ‘ তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে পাইকারি চালের দাম একটু চড়া। বস্তায় ৫০ টাকা বেড়ে গেছে। সেই চাল খুচরা বাজারে ২ থেকে ৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছে খুচরা বিক্রেতারা। টাউনহল বাজারের নোয়াখালী রাইস মিলের ইউসুফ জানান, প্রতি কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়ে গেছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পরেই। মিনিকেট ৭০ থেকে ৭২ টাকা কেজি, আটাশ ৫৪ থেকে ৫৭ টাকা, পাইজাম ৫২ থেকে ৫৪ টাকা কেজি। মোটা চাল পাওয়া যায় না। তবে পোলাও চালের দাম বেড়েছে খুবই বেশি। বর্তমানে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। যা আগে ১১০-১১৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হয়েছে।
ডলারের অজুহাতে সয়াবিন তেলের বাজারও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তেলের দাম বাড়ানোর জন্য। বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, বিষয়টি পর্যালোচনা করছে ট্যারিফ কমিশন। আর এই সুযোগ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা তেল মজুদ করা শুরু করেছেন। যার ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে। তারপর থেকেই বাজারে শাকসবজির দামও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে তার প্রভাব পড়েছে।
টাউনহলের সবজিবিক্রেতা জসিম ও অসীম ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রভাব ব্যাপকভাবে বাজারে পড়েছে। প্রতি কেজি সবজিতে গড়ে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ২০ টাকার পেপে ৪০ টাকা, শিম ২২০ টাকা, গাঁজর ১২০ টাকা, লাউ ১০০ টাকা পিস। ৫০ থেকে ৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। যা কয়েক দিন আগে ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকা কেজি বিক্রি করা হয়েছে। মাছের দামও কেজিতে বেড়েছে ৫০ টাকা।
আবাসনখাতেও নৈরাজ্য
নিত্যপণ্যের মতো আবাসন খাতের প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। রড, সিমেন্ট, ক্যাবল, ইলেকট্রিক সুইচ বোর্ডসহ বিভিন্ন পণ্য ইচ্ছামতো বিক্রি করছে খুচরা বিক্রেতারা। মোহাম্মদপুরের মদিনা ট্রেডিংয়ের মেহেদী জানান, ‘কয় দিন আগে ‘এ’ গ্রেডের রডের টন ৮৮ হাজার টাকার নিচে ছিল। এখন তা বেড়ে ৯০ হাজার টাকা। ৪৫০ থেকে ৪৯০ টাকার সিমেন্টের বস্তা ৫৫০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।
হাতিরপুলের ইস্টার্ন মোজাইক, জনতা মোজাইক, নভেলটি গ্যালারিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিক্রেতারা এ প্রতিবেদককে জানান, ‘আরএকেসহ অনেক কোম্পানিও টাইলসের দাম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে স্যানিটারি আইটেমের দামও। শরিফ, সাত্তারসহ বিভিন্ন কোম্পানির সাওয়ার, সিংক, ট্যাপকলসহ সব পণ্যের দামও ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। তারা বলছেন, ডলারের দাম বেশি। তাই বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে।’
এ ছাড়া বিবিএস, বিআরবি, পারটেক্সসহ অন্যান্য কোম্পানিও ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। সিদ্দিক বাজার ও টাউনহলের ক্যাবল বিক্রেতারা বলছেন, প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে ক্যাবল, ফ্যান, সুইচ, বোর্ড। রংয়ের দামও বেড়েছে একইভাবে আগের ১৪৪০ টাকার এক ড্রাম পাট্রি বর্তমানে ১৬৬০ টাকা, ৩০০০ টাকার সিলারের ড্রাম ৩৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে।’ এতো দাম বেশি কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, ‘আমাদের করার কিছু নেই। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
এদিকে বস্ত্র শিল্পের মধ্যে থ্রিপিস, শাড়ি, শার্ট-প্যান্টের দামও বেড়ে গেছে। মোহাম্মদপুরের টোকিও স্কোয়ার শপিং সেন্টারের চৈতির বিক্রয়কর্মী জাহিদ ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান,‘আগে যে থ্রি-পিস ১০০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হত, বর্তমানে তা ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। ২০০০ টাকারটা ২৫০০ টাকা হয়ে গেছে। ৪০০ থেকে ৬০০ টাকার শার্ট-প্যান্টের পিস ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।
এনএইচবি/আরএ/