ঋণখেলাপিদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুযোগ
করোনার নেতিবাচক প্রভাবসহ বহিঃবিশ্বে সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাবস্থা দীর্ঘ হওয়ার কারণে আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে চতুর্থবার পর্যন্ত ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ব্যাপারে সোমবার (১৮ জুলাই) একটি নতুন নীতিমালা জারি করা করা হয়েছে। খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হবে। যা আগে ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধ করা যাবে ৫ থেকে ৮ বছরে। আগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। ৫০ কোটি থেকে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ স্থিতিকারিরা এই সুবিধা পাবেন।
তবে কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ প্রথম বার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৩ বছর এবং দ্বিতীয় ও তৎপরবর্তী প্রতিবার পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেয়াদ আড়াই বছর দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক ঋণ হিসাবকে যে শ্রেণিমানেই অন্তর্ভুক্ত করা হোক না কেন, কোন পুনঃতফসিলকৃত ঋণকে ‘খেলাপি ঋণ’ এবং গ্রাহককে ‘খেলাপি ঋণগ্রহীতা’ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। তবে অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা উৎপাদনশীল খাতের অলাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের ক্ষেত্রে কঠোর বিধি-নিষেধ থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের পরিচালক মাকসুদা বেগম একটি মাষ্টার সার্কুলার সই করে বাংলাদেশে কার্যরত সকল তফসিলি ব্যাংকরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তাতে নির্দেশনা ও কিছু শর্তও দেওয়া হয়েছে।
নতুন এই নীতিমালায় খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংকমালিকেরাই এখন ঠিক করবেন, তাঁরা ঋণখেলাপিদের কী সুবিধা দেবেন। আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত, যা স্বয়ং গভর্নর অনুমোদন করতেন। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার সেই ক্ষমতার ব্যাংকের হাতে তুলে দিলেন।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শপথ নিয়েই বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করে তখন ব্যাংক মালিকরাও বলেছিলেন, এটা কার্যকর করা হবে। তারপরও বাড়ছে খেলাপী ঋণ। কোনোক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, করোনাকালে কিছু ছাড় দেওয়ার পরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নতুন করে অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি করোনায় অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে যে এক লাখ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, তারও বড় একটা অংশ অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। এ কারণে এখন ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নিয়মিত মেয়াদী ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত
নিয়মিত (অশ্রেণিকৃত: স্ট্যান্ডার্ড বা এসএমএ) মেয়াদী ঋণ (চলমান, তলবী বা অন্য কোন প্রকার ঋণ রূপান্তরের মাধ্যমে সৃষ্ট নয়) এর বিদ্যমান অবশিষ্ট মেয়াদের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মেয়াদ বর্ধিত করে ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে। কোন ঋণ হিসাবকে ঋণের মেয়াদের মধ্যে শুধুমাত্র একবার এরূপ পুনর্গঠন সুবিধা প্রদান করা যাবে। কোনো প্রকার ডাউন পেমেন্ট গ্রহণ ব্যতিরেকে মেয়াদী ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে। ঋণ পুনর্গঠন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটি অনুমোদিত হতে হবে। পুনঃতফসিলকৃত কোনো ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে না।
একগুচ্ছ নির্দেশনা
এ নীতিমালা ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ ও পুনর্গঠনের ন্যূনতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংকসমূহ ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করবে যা তাদের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। নীতিমালায় এ সার্কুলারে বর্ণিত শর্তাদির চেয়ে নমনীয় কোন শর্ত যুক্ত করা যাবে না। যে সকল গ্রাহক আর্থিকভাবে দুরবস্থায় রয়েছে বা গৃহীত ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ আদায়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে এরূপ ক্ষেত্রে যাতে নিয়মমাফিক পুনঃতফসিলিকরণ বা পুনঃপুনঃ পুনঃতফসিল পরিহার করা যায় সে লক্ষ্যে নীতিমালাটিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিশেষ করে, নীতিমালাটিতে অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা উৎপাদনশীল খাতের অলাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের ক্ষেত্রে কঠোর বিধি-নিষেধ থাকতে হবে।
পুনঃতফসিলকৃত ঋণের নির্দেশনা
গ্রাহকের বিদ্যমান আর্থিক সক্ষমতা ও পরিশোধের সামর্থ্য বিবেচনায় পুনঃতফসিলকৃত ঋণকে যে কোন শ্রেণিমানে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। এরূপ শ্রেণিকরণ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকরা পুনঃমূল্যায়ন করতে পারবে। ব্যাংক ঋণ হিসাবকে যে শ্রেণিমানেই অন্তর্ভুক্ত করা হোক না কেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ বিধানমতে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ পুনরায় খেলাপি হওয়ার পূর্বে কোন পুনঃতফসিলকৃত ঋণকে ‘খেলাপি ঋণ’ এবং গ্রাহককে ‘খেলাপি ঋণগ্রহীতা’ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
জেডএ/