বাজেট ভাবনা: ২০২২-২৩
ভর্তূকি ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর তাগিদ অর্থনীতিবিদদের
করোনার ধকল না সামলাতেই ইউক্রেন-রাশিয়ার প্রভাবে চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রায় নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়েছে। চরম ভোগান্তিতে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। এ অবস্থা মোকাবেলায় ব্যবসায়ীরাও একটি শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট দাবি করেছেন।
অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে মানুষকে রক্ষা করতে হবে। অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। ভর্তূকি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়াতে হবে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। করের বোঝা না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে।
সার্বিক দিক বিবেচনা সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে-জনগণের ভোগান্তি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য এবারও উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে বাজেটের আকার বাড়ানো হচ্ছে। তাই চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ছয় লাখ ৭৮ হাজার কোটি ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে। এজন্য রাজস্বও ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা থেকে তিন লাখ ৭৯ কোটি টাকা বেশি প্রাক্কলণ করছে।
এফবিসিসিআইর উপদেষ্টা মন্জুর আহমেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, `করোনার সঙ্গে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে দেশে নিত্যপণ্যের ভয়াবহ সংকট পড়েছে। তাই এবারের বাজেটও চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। ট্যাক্স না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়াতে হবে। লাইসেন্সধারি সব ব্যবসায়ীকে করের আওতায় আনতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ঢেলে সাজাতে হবে। জীবনযাত্রার ব্যয়, মুদ্রাস্ফীতি ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ব্যক্তি শ্রেণির আয়করের সীমা তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা নির্ধারণ করা দরকার। এফবিসিসিআই থেকে সেই প্রস্তাবও করা হয়েছে। একই সঙ্গে নিম্ন আয় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য্য পণ্য, নিত্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবা খাতে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া দরকার।’
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘মানুষের হাতে টাকা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। ঝামেলামুক্তভাবে ট্যাক্স দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে সাবেক কৃষি সচিব মো. ইউনুসুর রহমানও বলেন, ‘প্রথাগত অবস্থা থেকে বেরিয়ে এবার রিকভারি (পুন:রুদ্ধার) বাজেট দিতে হবে। কোভিডের মোকাবেলা করতে খাদ্য মজুদ বাড়াতে কৃষিতে ভর্তূকি বাড়াতে হবে। কারণ বিশ্বে যা হচ্ছে খাদ্য পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। তাই সারে ভর্তুকি দিতেই হবে।’
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘করোনায় সবচেয়ে এসএমই খাত বেশি ক্ষতি হয়েছে। তাই প্রণোদনার মাত্রা আরও বাড়াতে হবে। ট্যাক্স এর পরিমান না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে। আমদানি যেভাবে বাড়ছে রপ্তানি বাড়লেও রেমিটেন্স বাড়ছে না। তাই রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় এনবিআরকে ঢেলে সাজাতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘বিভিন্ন কারণে এবারের বাজেট উদ্ভাবনীমূলক করতে হবে। শিশুদের জন্য কিছু জায়গায় ট্যাক্স কমাতে হবে। আবার টোব্যাকোর মতো কিছু ক্ষেত্রে করপোরেট ট্যাক্স বাড়াতে হবে। আগামীর বাজেটে মানুষকে একটু স্বস্তি দিতে ছাড়ও দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছর ঘনিয়ে আসায় সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে ‘বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ’ কমিটির বৈঠকে আগামী অর্থবছরের বাজেটের একটি রূপরেখা তুলে ধরেন অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। এই রূপরেখাকে সামনে রেখেই চূড়ান্ত বাজেট প্রস্তুত করা হবে। আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে চূড়ান্ত বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী।
আমদানির বিপরীতে রপ্তানি কম হওয়ায় উদ্বেগে সরকার। কারণ আমদানি যে হারে বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে সে তুলনায় কম। এর মধ্যে আবার রেমিট্যান্সে ধারাবাহিকভাবে পতন হচ্ছে। আবার খাদ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি, জ্বালানিসহ সামাজিক নিরাপত্তা খাতেও ভর্তূকি ও নগদ সহায়তা রয়েছে। অপরদিকে ভর্তূকির কারণে চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় (রিজার্ভ)। ৪৮ বিলিয়ন থেকে রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। টাকার মানেরও পতন হচ্ছে।
এদিকে, করোনার কারণে দেশে দারিদ্রের হার বেড়ে গেছে। কর্মহীনও হয়ে গেছে কয়েক লাখ মানুষ। তাই সরকারও খোলা বাজারে বিক্রিসহ বিভিন্ন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির জন্য চাল ও গম কিনছে। এর কিছু অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে এবং কিছু আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। করোনা এবং বৈশ্বিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি বাড়াতে হচ্ছে সরকারকে।
তাই আগামী (২০২২-২৩) অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকির চাপ বাড়ছে। এরফলে বাড়তে পারে বাজেট ঘাটতি ও সরকারের ঋণ গ্রহণ।
চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার হচ্ছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। তা থেকে বাড়িয়ে আগামী অর্থবছরে অর্থ বিভাগ ছয় লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করেছে।
আসছে বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে দুই লাখ ৪৬ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এডিপির আকার হচ্ছে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।
আর আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্য বিবেচনা করছে। বর্তমানে ধরা আছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। নতুন করে মূল্যস্ম্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এনবিআরের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ৯.৫ শতাংশ)। আগামী অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
সরকারের আয় ব্যয় মেটাতে নতুন বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হচ্ছে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫.৫৫ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতি জিডিপির ৬.২ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। সে হিসাবে ঘাটতি কমানোর প্রস্তাব থাকছে বাজেটে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে করোনাসহ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে দেশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে যে চাপে পড়েছে তা নিরসনের ব্যবস্থা থাকছে আগামীর বাজাটে। বুধবার (২০ এপ্রিল) অর্থনৈতিকবিষয়ক ও ক্রয় কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন ‘দেশের জনগণের কষ্ট লাঘবে স্বস্তিদায়ক বাজেট দেওয়া হবে। নতুন বাজেটে এমন কিছু করা হবে না, যাতে সাধারণ জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। চাপ সামলানোর জন্য যা কিছু দরকার আমরা আগামী বাজেটে তাই করব।’
জেডিএ/