অসাধু ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া, জরিমানায়ও সুফল মিলে না
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা রমজান মাসে ভোক্তাদের কম দামে পণ্য বিক্রি করেন। অথচ আমাদের দেশে কম দামে তো দূরের কথা ভিন্ন মাত্রায় প্রতারণা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা। হোটেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ইফতার বিক্রি, বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে সেমাই তৈরি, বেশি দামে মাংস ও বাসের টিকিট বিক্রি করছে তারা। বাটা, এপেক্স জুতা সিল মেরে নকল করে বিক্রি করা। এভাবে খাওয়া, পরা থেকে শুরু করে যাতায়াতের ক্ষেত্রেও ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
এসব অসাধু তৎপরতা ঠেকাতে ভ্রাম্যামাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়। আদায় করা হয় জরিমানা। কিন্তু অসাধু তৎপরতা বন্ধ হয় না।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন সম্প্রতি বলেন, সৌদি আরবসহ বিশ্বের অনেক দেশ রমজান মাসে খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে দেয়। অথচ আমাদের দেশে রমজান মাস আসার আগেই সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কেউ ভোক্তাদের ঠকালে তার দায়ভার নেবে না এফবিসিসিআই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অবশ্যই এটা কঠোরভাবে দেখবে।
নকল বাটা, এপেক্স তৈরি
বুধবার (২০ এপ্রিল) রাজধানীর কদমতলী থানাধীন জুরাইন-পোস্তগোলা এলাকার আলম সুপার মার্কেটে আব্দুস সাত্তার সুজ নামের কারখানায় বাটা, এপেক্সসহ নামী-দামি ব্র্যান্ডের লোগোর আদলে নকল লোগো দিয়ে স্যান্ডেল তৈরি করছে। এপেক্স হয়ে গেছে এডেক্স ও বাটা হয়েছে বালা। এছাড়া এপেক্সের লোগো হুবাহু নকল করা হচ্ছে। কারখানাটির কোনো ধরনের অনুমোদন ছিল না। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির ট্রেড লাইসেন্সও ছিল না। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা করে। ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মন্ডলের নেতৃত্বে ওই কারখানাকে সিলগালা ও জরিমানা করা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি যে ধরনের লোগো ব্যবহার করেছে, সে ধরনের কোনো কাগজপত্র প্রতিষ্ঠানটির ছিল না। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ট্রেড লাইসেন্সও ছিল না। তারা অবৈধভাবে স্যান্ডেল তৈরি করছেন।’ এভাবে বুধবার সারা দেশে ভোক্তা-স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন অপরাধে ১৫৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১১ লাখ টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে।
১৭শ টাকার শাড়ি ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি
রাজধানীর মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে সরেজমিনে দেখা যায় বিভিন্ন দোকানে কোনো নিয়মের ধার ধারে না। ইচ্ছামতো দাম নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এ সময় তাওসিফ বেনারসিতেও দেখা যায় নেই কোন ক্রয়ের রশিদ, দেয়া হয় না বিক্রির রশিদ। বাধ্য হয়ে ভোক্তা অধিদপ্তর ১৭ এপ্রিল অভিযানে নামে। এ সময় ৪৫ ধারায় ওই প্রতিষ্টানটিকে জরিমানা করেছে।
একই দিনে নিউমার্কেটের ইরো ইথিক ওয়্যার নামে পাঞ্জাবির দোকানে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তর। কারণ এ প্রতিষ্ঠানটি মূল্য ছাড়ের নামে ভোক্তাদের সঙ্গে অভিনব প্রতারণা করে। অর্থাৎ পাঞ্জাবির প্রকৃত দাম ১ হাজার ১৯০ টাকা। মূল্য ছাড়ের নামে সেই পাঞ্জাবির দাম লাগানো হয়েছে ২ হাজার ৪৯০ টাকা। এই মূল্যের ৫০ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্টিকারের নিচে আরেকটি স্টিকার লাগানো রয়েছে। সেখানে মূল্য লেখা রয়েছে ১ হাজার ৭৯০ টাকা এবং এর নিচে আরও একটি স্টিকার রয়েছে। সেখানে মূল্য লেখা রয়েছে ১ হাজার ১৯০ টাকা।
এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক, ঢাকা জেলা প্রধান মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, ‘ইরো প্রতিষ্ঠানের যেসব পণ্যে ছাড় দেবার কথা বলা হয়েছে, সবগুলোতেই প্রতারণার প্রমাণ পাওয়া যায়। যার ভিত্তিতে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে’।
শুধু পোশাকের ব্যবসায়ীরা নয়, ইফতারির আইটেম ও খাদ্যের ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে অসাধু ব্যবসায়ীরা দ্বিধারোধ করছে না। অস্বাস্থকর পরিবেশে ধানমন্ডির মিরপুর রোডে রস মিষ্টির সৃষ্টি খাদ্য পরিবেশন করতে দেদারসে। রবিবার ভোক্তা অধিদপ্তর ৪০ ও ৪৩ ধারায় জরিমানা করেছে।
ঈদ না আসতে না আসতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই ব্যবসাও জমজমাট করতে মেতে উঠেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। রবিবার কামরাঙ্গীরচরের আশার আলো সেমাই ঘরকে ৪৩ ধারায় জরিমানা করা হয়েছে।
এদিকে শনিবারও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ও অবৈধভাবে খাদ্য বিক্রির কারণে পল্লবীর আল বারাকা হোটেল ও মিরপুরের শাহ আলী বাজারের ডি অ্যান্ড ব্রাদার্সকে জরিমানা করা হয়েছে। একই দিনে সঠিক মাপ না দেওয়ায় নিউমার্কেটের আল মদিনা এন্টারপ্রাইজ ও পল্লবীর মিতু কাতান শাড়িঘরকে জরিমানা করা হয়েছে। ওই দিনে মোহাম্মদপুরের বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার, মদিনা ব্রয়লার হাউজ ও নিউ মডার্ণ হাউজকেও জরিমানা করা হয়েছে।
শুধু খাবার বা পোশাকে প্রতারণা নয়, ঈদকে সামনে রেখে যাতায়াতের জন্য পরিবহন ক্ষেত্রেও ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে প্রতারণা করতে দ্বিধাবোধ করছে না। ভোক্তা অধিদপ্তর সোমবার (১৮ এপ্রিল) কল্যাণপুর ও গাবতলীতে মানিক ট্রাভেলস, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, গ্রামীণ পরিবহন, এইচআর ট্রাভেলস ও ঈগল পরিবহনসহ আট কাউন্টারকে জরিমানা করা হয়েছে বলে প্রতিষ্টানটির পরিচালক উপসচিব মনজুর ও উপ সচিব মো. শাহরিয়ার জানান।
উল্লেখ্য, ভোক্তাদের স্বার্থে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। এ জন্য তারা বাজার ব্যবস্থা দেখার চেষ্টা করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এক লাখ সাড়ে ২২ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্টানকে জরিমানা
অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করায় ২০০৯ সাল থেকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত মার্চ পর্যন্ত জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। এই সময়ে প্রতিষ্টানটি এক লাখ সাড়ে ২২ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্টানকে ৮৯ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করেছে। পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা, মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি, নির্ধারিত তালিকার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি, নকল পণ্য প্রস্তুত করা, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রিসহ ৩৭ থেকে ৫৫ ধারায় ওই সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। একই সঙ্গে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবারও জরিমানা করা হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযোগ করায় সাত হাজার ২৪৪ জন ভোক্তাকে সোয়া কোটি টাকারও বেশি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
এদিকে খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআইও বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। সংস্থিাটি বনানী থানা এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সোমবার (১৮ এপ্রিল)। এ সময় ৫০/৫২, কামাল আতার্তুক এভিনিউর ননী ফুল ক্রিম সুইটসকে ওজনযন্ত্রের ভেরিফিকেশন সনদ হালনাগাদ না করায় এবং পণ্য নিমকি, বিস্কুট, চিড়া ভাজা ও লাচ্ছা সেমাই এর অনুকূলে পণ্য মোড়কজাতকরণ সনদ দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় জরিমানা করা হয়।
বিএসটিআই'র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আমিমুল এহসান এর নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত হয়। আগের দিন ১৭ এপ্রিলও রাজধানীর দারুস সালাম থানা এলাকায় শাহ-আলী শপিং কমপ্লেক্স এর দেওয়ান জুয়েলার্সকে ওজনযন্ত্রের ভেরিফিকেশন সনদ গ্রহণ না করার অপরাধে জরিমানা করা হয়। বিএসটিআই'র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আমিমুল এহসানের নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালিত হয়।
জেডএ/