বাজারে খোলা সয়াবিন তেল সংকট
আবারও দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা
রমজান মাসের আগে সয়াবিন তেল নিয়ে সিন্ডিকেট শুরু হয়েছে। চার রোজা চলে গেছে। তারপরও সিন্ডিকেট মুক্ত হতে পারছে না। মিলমালিকরা তেল আছে, দেওয়া হচ্ছে বললেও খোদ তেলের পাইকারি মৌলভীবাজার, কৃষিমার্কেটসহ বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ীরা তেল পাচ্ছে না। তেল দিচ্ছে না মিল থেকে। তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে হাহাকার পড়ে গেছে খোলা সয়াবিন তেলে। নির্ধারিত মূল্য ১৬০ টাকা লিটার হলেও রূপচাঁদা লুজ তেল (গায়ের রেট) ১৬৫ টাকা বিক্রি করছে। আর ১৩৬ টাকা লিটারের খোলা তেল ১৪৫ টাকা হয়ে গেছে। বুধবার (৬ এপ্রিল) রাজধানীর কৃষিমার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে এমনই চিত্র দেখা গেছে।
কৃষিমার্কেটের সিটি এন্টারপ্রাইজের আবু তাহের ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘তেল নেই বহু দিন থেকে। তীর, বসুন্ধরা, রূপচাঁদা কোনো ব্র্যান্ডের তেল পাওয়া যাচ্ছে না। তারা দিব দিব করেও তেল দিচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে তেল নিয়ে হচ্ছে কি? এভাবে ব্যবসা করা যাবে না। ক্রেতারা গালাগালি করছেন। কারণ বিভিন্ন পণ্য দেওয়ার সময় তেল চাইলেও দিতে পারছি না। এভাবে আর কতো দিন। সরকার বলছে, সব ঠিক হয়ে গেছে। খোলা তেল ১৩৬ টাকা লিটার মিলমালিকরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু কেউ তেল দিচ্ছে না। আগে ১০০ থেকে ২০০ কার্টুন তেল থাকত দোকানে। কিছু দিন থেকে কোনো তেল পাচ্ছি না। তাহলে কি বিক্রি করব। শিশু হাসপাতালের ক্যান্টিনে তেল দেওয়া হয়। ১০ দিনে ১৫ কার্টুন তেল দিতে হয়। কিন্তু দিতে পারছি না। বসুন্ধরা বলছে ডিও হয়নি। তেল নেই। রূপচাঁদাও একই কথা বলছে। ৮ দিন আগে বলার পরও মাত্র ২ কার্টুন দিয়েছে। নির্ধারিত মূল্য ১৬০ টাকা লিটার হলেও রূপচাঁদা লুজ তেল (গায়ের রেট) ১৬৫ টাকা হয়ে গেছে। ১৬৩ টাকার কম দেয় না।
আর খোলা তেল তো সোনার হরিণ হয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে একজন চাই ৩১ হাজার ৮০০ টাকা ড্রাম । তাতে ১৮৪ লিটার তেল ধরে, লিটার পরে ১৭৩ টাকা। যেখানে সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে লিটারে ৩০ টাকা বেশি। এভাবে কি ব্যবসা করা যায়। এই দামে বিক্রি করতে চাইলে ক্রেতারা একেবারে মেরে ফেলবে। জীবনে কখনো এমন অবস্থা দেখিনি।’
একই বাজারের রূপসা রাইস এজেন্সির মালিক নুরুল আমিনও ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, ‘কোনো তেল নেই। দেখেন বাজারের চার্টে তেল উল্লেখ করা নেই। এমন কেন অবস্থা জানতে চাইলে তিনি আর ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘ দেখেন আসলে তেল দিবে মিল থেকে কিন্তু সেই মিলের লোকের বলছে তেল নেই। আসলে হচ্ছে কি? এর সমাধান কোথায়? এইতো কয়দিন আগে সরকার থেকে বলা হলো খোলা তেল ১৩৬ টাকা, প্যাকেট তেল ১৬০ টাকা লিটার বিক্রি করতে মিলমালিকরা রাজি হয়েছে। পর্যাপ্ত তেল রয়েছে। কিন্তু বাজারে তার উল্টো চিত্র। রমজান মাসেও আমরা তেল পাচ্ছি না। তাই ক্রেতাদের দিতে পারছি না।’
কৃষিমার্কেটের সূর্য স্টোরের আবু হানিফ বলেন, ‘যা নেন, নেন ৫ লিটার একপিস দেওয়া যাবে, দাম ৭৬০টাকা। এর বেশি দেওয়া যাবে না। রূপচাঁদা কোম্পানি থেকে এক মাস ১০ দিন পর ১০টা বোতল দিল, কয়েকটা পলি দিল। মেমো দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই হচ্ছে অবস্থা এক লিটার ৪০টা কার্টুন, ৫ লিটার ৪০ টা তেল দিয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত আসলে বলেন যে মিল থেকে তেল দিচ্ছে না। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘হাহা হাসার কথা কইলেন।’
উল্লেখ্য, সয়াবিন তেলের সংকট দেখিয়ে শবে বরাতের আগে ৫ লিটার ৮০০ টাকায় বিক্রি করে মিলমালিকরা। এ নিয়ে দেশে হই-চই পড়লে সরকার ট্যাক্স ভ্যাট কমিয়েছে। ২০ মার্চ বোতলজাত সয়াবিন তেলে আট টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা লিটার এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম সাত টাকা কমিয়ে ১৩৬ টাকা লিটার নির্ধারণ করে সরকার। আর প্রতি লিটার পাম তেল ১৩৩ টাকা থেকে কমিয়ে ২২ মার্চ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে মিলমালিক ও সরকার।
তেলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরাও নড়েচড়ে বসে। তারা সব খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। সরবরাহও স্বাভাবিক পর্যায়ে। তাই রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না।
সর্বশেষ গত ২ মার্চ রমজানের আগের দিন এফবিসিসিআইর উদ্যোগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মজুত, আমদানি, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি বিষয়ক মতবিনিময় সভা করে আশ্বাস দেন ব্যবসায়ীরা কোনো জিনিসের দাম বাড়াবে না। শুধু তাই নয়, রমজানে বাজার স্বাভাবিক রাখতে এফবিসিসিআই’র পক্ষ থেকে ৪৬ সদস্য বিশিষ্ট বাজার মনিটরিং কমিটি গঠনও করা হয়েছে।
তারপরও বাজারে খোলা তেল পাওয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, বছরে দেশে ২০ লাখ টন সয়াবিন তেল লাগে। মাসে লাগে গড়ে এক লাখ ২০ হাজার টন। তবে রমজানে আড়াই লাখ টন লাগে। কিন্তু সরবরাহ বেশি থাকলেও বাজারে এখন খোলা তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কোথাও পেলে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে বিক্রেতারা অভিযোগ করে জানান।
এ ব্যাপারে কারওয়ান বাজারের আলী স্টোরের মালিক মো. আলী হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে সয়াবিন তেলের দাম ৫ লিটার ৮০০ টাকা থেকে কমে ৭৬০ টাকা ও এক লিটার ১৭০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ১৪৫ টাকা দিলে বিক্রি করা হবে।’ আর আব্দুর বর স্টোরের রব বলেন, ‘নেই খোলা তেল। কেন নেই? তার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বেশি দামেও পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের কারণ জানা নেই’
এদিকে খোলা সয়াবিন তেলের মোকাম মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির প্রেসিডেন্ট গোলাম মাওলাও ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আপনারাই বলেন, এফবিসিসিআই থেকে শুরু করে সরকারের ভোক্তা অধিদপ্তর পর্যন্ত এতো কিছু করার পরও মাল দেলিভারি দিচ্ছে না মিল থেকে। ওই সময়ে তারা কোনো সমস্যা নেই বললেও আন লিমিটেড মাল পাওয়া যাচ্ছে না। তারা দিচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজন মতো না। এসও (বিক্রয় অর্ডার) ১৫ দিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেও বেশি করে দিচ্ছে না।’
এখনো বাজারে তেলের সংকট কেন? জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ বুধবার (৬ এপ্রিল) মিলমালিকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। তারা বলেছেন, তেলের কোনো অভাব নেই। মার্চে কম থাকলেও এপ্রিলে উৎপাদন সর্বোচ্চ অবস্থায় চলে এসেছে। তাদের উৎপাদন ঠিক আছে কি না তা যাচাই করা হচ্ছে। তারপরও কেউ তেল না পেলে আমাদের কাছে অভিযোগ করলে মিল থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ আগে যাই হোক বর্তমানে তেলে সয়লাব হয়ে গেছে। যার যতো দরকার দেওয়া যাবে। কৃষিমার্কেট ও কারওয়ান বাজারে খোলা তেল পাওয়া যায় না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে তেল নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করতে বলেন, ট্রাকে করে পাঠিয়ে দিব।’
জেডএ/