হোটেলে খাবারের দাম বাড়ায় দিশেহারা নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ
ঢাকার ছোট-বড় সব হোটেলগুলোতে খাবারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। আর এ কারণে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছেন।
বর্তমানে ১৫ টাকার ডাল বিক্রি করা হচ্ছে ২০ টাকায়। এ হিসাবে দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৩ শতাংশ। কারওয়ান বাজারের ‘হোটেল হাজীর বিরিয়ানি’র সুমন এমনটিই জানালেন।
এই এলাকার নামকরা হোটেল সুপার স্টারে ডালের দাম বাড়ানো হয়েছে ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ ৩০ টাকার ডাল বিক্রি করা হচ্ছে ৩৭ টাকায়। শুধু তাই নয়, তন্দুরি রুটিতে বাড়ানো হয়েছে ৪০ শতাংশ। সে হিসাবে ১০ টাকার রুটির দাম হয়েছে ১৪ টাকা পিস। ৪২ টাকার ভাজি বিক্রি করা হচ্ছে ৫৪ টাকা। এ হিসাবে দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশ।
অন্যদিকে, ৩০ টাকা প্লেটের শাকের দাম রাখা হচ্ছে ৩৫ টাকা অর্থাৎ দাম বাড়ানো হয়েছে ১৭ শতাংশ। প্রতি পিস ডিম পোচ বা ভাজিতে বেড়েছে ১০ শতাংশ। অর্থাৎ ২০ টাকার ডিম রাখা হচ্ছে ২২ টাকা। তবে উচ্চবৃত্তের পছন্দের কাচ্চি বিরিয়ানি, বাসমতির কাচ্চির দাম বেড়েছে প্লেটপ্রতি মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ।
শুধু এই দুটি নয়, মোহাম্মদপুরের নাহিদ হোটেলসহ রাজধানীর ছোট-বড় প্রায় সব হোটেলে রমজান মাসের আগেই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের খাবারের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়েছেন কোনো কোনো হোটেল মালিকরা। হোটেল সুপার স্টার তিন মাসে দুইবার দাম বাড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর অজুহাতে তারা এভাবে দাম বাড়িয়েছেন। কিন্তু সরকারের কড়াকড়িতে সম্প্রতি তেল থেকে শুরু করে পেঁয়াজ, আদা রসুনের দাম কমতে শুরু করলেও হোটেলের খাবারের দাম কমবে না বলে বিভিন্ন হোটেল মালিক এমনকি বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ সমিতির পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সবাই নিজের মতো করে ব্যবসা করছে। কাজেই একেক জন একেক রকম পণ্যের দাম নিবে এটাই স্বাভাবিক। ছোট হোটেলের চেয়ে বড় হোটেলে বেশি দাম আদায় করছে মালিকরা।
এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বড় হোটেলে কর্মচারীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপারেটিং কস্ট (পরিচালনা খরচ) বেশি। তাই হোটেল সুপার স্টার লিমিটেডসহ অনেকে এ বছরই হয়ত দুই বার পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। তবে খাবারের দাম সহনশীল রাখার জন্য হোটেল মালিকদের আহবান জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এখন তেল, গরুর মাংসসহ সব কিছুর দামই বাড়ছে। কীভাবে খাবারের মান ধরে রাখব তা জানি না। বাধ্য হয়ে আমরা যেসব নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে তা টিসিবি’র মাধ্যমে নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে। আমরা নিজেরা একটা মিটিং করে হয়তো মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের কাছে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবি করা হবে।’
রাজধানীর নামকরা হোটেল সুপার স্টারে সরেজমিনে দেখা যায়, ২০ মার্চ থেকে প্রতি পিস তন্দুরি রুটি বিক্রি করা হচ্ছে ১৪ টাকা, যা গত ৯ জানুয়ারি থেকে বিক্রি করা হতো ১০ টাকা, বেড়েছে ৪০ শতাংশ। ১৫ টাকার পাতলা নান রুটি হয়েছে ২২ টাকা, বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। ২০ টাকার স্পেশাল পরাটা ২৭ টাকা, বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। ১০ টাকার ডালপুরি ১২ টাকা, বেড়েছে ২০ শতাংশ। এ ছাড়া ৩০ টাকার শাক হয়েছে ৩৫ টাকা, বেড়েছে ১৭ শতাংশ। ৩০ টাকার লাউ হয়েছে ৩৫ টাকা। ৩২ থেকে ১৬ টাকার মসুরির ডাল ৪০ থেকে ২০ টাকা প্লেট বিক্রি করা হচ্ছে। ৫২ টাকার কফি ৬০ টাকা, ২১ টাকার চা ২৫ টাকা কাপ, ১৮০ টাকার লাচ্চি লিটার ২০০ টাকা, ৫২ টাকার মোগলাই পরাটা ৬০ টাকা পিস বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবে ওই হোটেলের পণ্য তালিকার ৯২টি পণ্যের মধ্যে প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়িয়েছে।
তিন মাসে দুই বার দাম বাড়ানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে হোটেল সুপার স্টার লিমিটেডের কারওয়ান বাজার শাখার ক্যাশিয়ার আরিফ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আগের তালিকা নেই। তা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ২০ মার্চ থেকে যে খাবারের তালিকা তৈরি করা হয়েছে তার মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, আমরা কর্মচারি, তাই এর বাইরে কিছু বলা যাবে না। বেশি কিছু জানতে চাইলে পুরান ঢাকায় হেড অফিসে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। তবে কারো কোনো ফোন নম্বর তিনি দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
এদিকে কারওয়ান বাজারের চারুলতা রেস্তোরাঁর ম্যানেজার মাহবুব আলম ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘তিন বছর থেকে এ হোটেলে কোনো জিনিসের দাম বাড়ানো হয়নি। অপরদিকে কয়েক মাস থেকে সব জিনিসের দাম বেড়েছে। তাই গত ডিসেম্বর থেকে কোনো কোনো জিনিসের দাম বাড়ানো হয়েছে। কাচ্চি বিরিয়ানি, চিকেন বিরিয়ানিতে ১০ টাকা করে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা ও ১৪০ টাকা প্লেট বিক্রি করা হচ্ছে। গরুর খিচুরি ও চিকেন খিচুরিতে ১০ টাকা বাড়িয়ে ১৬০ টাকা ও ১৪০ টাকা প্লেট বিক্রি করা হচ্ছে। তবে ৮ টাকার তন্দুর রুটি বর্তমানে ১০ টাকা পিস, ২৫ টাকার নান রুটির পিস ২৫ টাকা, ২০ টাকার সবজি ২৫ টাকা প্লেট, ১৫ টাকার ডাল ২০ টাকা প্লেট বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পণ্যে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
এটা অনেক বেশি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘২২০০ টাকার আটার বস্তা হয়েছে ৩৬০০ টাকা, এখনো প্রতি লিটার ১৫০ টাকার কমে পামওয়েল পাওয়া যায় না। একই সঙ্গে বিভিন্ন মসলার দামও বেড়েছে। তাহলে কিভাবে কমবে দাম। যেভাবে বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়েছে সেভাবে বাড়ানো হয়নি আমাদের হোটেলে পণ্যের দাম।’
বাড়তি দামের ব্যাপারে কথা হয় আহসান হাবীব নামের এক সবজি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘খাবারের দাম এতবেশি বেড়েছে যে আমাদের আর বেঁচে থাকার উপায় নেই। বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপে ভোজ্যতেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দাম কমলেও খাবার দোকানগুলোতে এর তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই।’
দেশের মানুষ যাবে কোথায়? যেন এগুলো দেখার কেউ নেই, যোগ করেন তিনি।
জেডএ/এমএমএ/