মিলে মিলে অভিযান, কমানো হলো ২০ শতাংশ ভ্যাট
কমবে কি সয়াবিন তেলের দাম?
প্রতিদিন বাজারে শত শত ট্রাকে ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হচ্ছে বলে মিলমালিকরা দাবি করছে। তবে ডিলার এবং ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাস পার হয়ে গেলেও পাওয়া যাচ্ছে না তেল। বাধ্য হয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শুক্রবার থেকে রশিদ ছাড়া কোনো তেল বিক্রি করা যাবে না। শুধু তাই নয়, মিলমালিকরা পর্যাপ্ত তেলের যে তথ্য দিয়েছে, তা যাচাই করতে মিলে মিলে অভিযান শুরু করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রূপগঞ্জের তীর ও রূপচাঁদা মিলে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কোনো কারসাজি ধরা পড়লে কেউ রেহাই যাবে না। শুধু তা-ই নয়, ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বৃহস্পতিবার ভোজ্যতেলের উপর ২০ শতাংশ ভ্যাট তুলে নেওয়া হয়েছে। তারপরও শঙ্কায় ভোক্তারা। বলছেন, ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর উৎপাদন তথা মিলমালিকদের জন্য ১৫ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে মিল মালিকরা তেলের দাম বাড়াতে চাইলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। বরং সরকার গত ৬ ফেব্রুয়ারি ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে- খোলা তেল ১৪৩ টাকা লিটার ও প্যাকেটজাত তেল ১৫৮ টাকা। তারপর থেকেই দেশে বাড়তে শুরু করেছে তেলের দাম। এমন অবস্থায় সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, রমজান মাসের আগে আর বাড়ানো হবে না তেলের দাম।
সরকার অনুমোদন করার আগেই বিভিন্ন মিল মালিকরা ২ লিটার ৩৩৫ টাকা এবং ৫ লিটার ৮০০ টাকা তেল ছেড়ে দিয়েছে বাজারে। তারপরও গত সপ্তাহে থেকে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না সয়াবিন তেল। বাধ্য হয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করেছে। প্রতিদিন ধরা পড়ছে মজুদকারিরা।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) দেশের সব মিলমালিক ও ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী নেতাদের নিয়ে ৭ মার্চ মত বিনিময় সভার আয়োজন করে। সভায় মিলমালিকের পক্ষ থেকে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে তেলের দাম। তাই দেশেও বাড়ানো দরকার। একই সঙ্গে তারা বলেন, দেশে তেলের কোনো সংকট নেই। প্রতি দিন শত শত ট্রাক তেল সরবরাহ করা হচ্ছে।
মিলমালিকদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে তেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোনো কোনো মিল মালিক এক মাস আগে এসও নিয়েও তেল দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে কোনো কোনো ব্যবসায়ী হয়ত তেল লুকিয়ে রাখছে। তাই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। মিলমালিকরা ঠিকমতো তেল দিলে বাজারে কোনো সংকট হবে না।
এ ব্যাপারে এফবিসিসিআইর সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘রোজা পর্যন্ত দেশে তেলের কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ববাজারে আজ বাড়লে দেশে আজকেই কেন দাম বাড়বে? দুই মাস পর বাড়বে। গুটি কয়েক অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য পুরো ব্যবসায়ী সমাজের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এফবিসিসিআই এসব ব্যবসায়ীদের দায় নেবে না। ব্যবসা করতে এসেছি। চোর-বাটপারি করতে না। খোলা তেলের মূল্য না থাকায় অনেকে ইচ্ছামতো দাম নিচ্ছে। তাই খোলা তেল বন্ধ করতে হবে। সরকারি নির্ধারিত দামে তেল বিক্রি এবং মিলমালিকদের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে।’
এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে নড়েচড়ে বসেছে। এর আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার মিলমালিকসহ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চায় আসল কাহিনি কী?
সেখানেও মিলমালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশে পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় হাজার ট্রাক তেল সরবরাহ করছে। তাদের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে তেল ব্যবসায়ীরা বলেন, এসও করার মাস পার হলেও মিল থেকে দেওয়া হচ্ছে না তেল। এমনকি কোনো কোনো মিলে ট্রাক প্রতি ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। প্রতি ট্রাকে ১১ টন তেল থাকে। এই টাকা দিলেই মিল থেকে পাওয়া যাচ্ছে তেল। এই বাড়তি টাকা ভোক্তাদের পকেট থেকে কাটা হচ্ছে। তাতে এই কয় দিনে ভোক্তাদের কাছ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা চলে গেছে।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেন বাবুল বলেছৈন, ‘মিল মালিকরা চাহিদা মতো সয়াবিন তেল দিচ্ছে না। তারা ঠিকভাবে দিলে রমজান পর্যন্ত অস্থির বাজারকে স্থির করা হবে।’ একই বাজারের গোলাম কিবরিয়াও বলেছেন, ‘মিল মালিকরা ঠিকমতো তেল দিলে দাম বাড়বে না। রমজানে প্রয়োজনে কেনা দামে বিক্রি করব তেল, বাজার স্থিতিশীল হবে।’
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, ‘বছরে ২০ লাখ টন সয়াবিন তেল লাগে। মাসে লাগে এক লাখ ২০ হাজার টন। তবে রমজানে আড়াই লাখ টন লাগে। মিল মালিকরা বলছে তেল আছে, ব্যবসায়ীরা বলছে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে কোনো লাভ হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুক্রবার (১১ মার্চ) থেকে ভোজ্যতেল কেনাবেচায় পাকা রশিদ ছাড়া কোনো ব্যবসা করা যাবে না। তা করলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিলে মিলে অভিযান হবে। ৬ ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত দামের বেশি কেউ তেল বিক্রি করতে পারবে না। খোলা তেল ১৪৩ টাকা আর প্যাকেট তেল লিটারপ্রতি ১৫৮ টাকা। এর বেশি কেউ আদায় করলে রেহাই পাবে না। ধরা পড়লে কেউ ছাড় পাবে না। আর মিলমালিক যে তথ্য দিয়েছে তা যাচাই করতে মিলে মিলে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এরই অংশ বিশেষ বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) থেকেই রূপগঞ্জের তীর ও রূপচাঁদা মিলে অভিযান শুরু হয়েছে। অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে এই দুই মিলের সব কিছু দেখা হয়েছে। পর্যালোচনা করে কোনো বিভ্রান্তি ধরা পড়লে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সূত্র জানায়।
এদিকে ভোক্তাদের স্বার্থে পাকা রশিদ ছাড়া তেল কেনাবেচা ব্যাপারে চানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের মিলু ট্রেডার্সের মালিক মিলু ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘প্যাকেটজাত তেলে কোনো সমস্যা নেই। খোলা তেলে এই হয়ে থাকে। তাই শুক্রবার থেকে পাকা রশিদ দেওয়া হবে। কোনো সমস্যা নেই।’
তবে একই বাজারের খুচরা বিক্রেতা মেসার্স ইউসুফ জেনারেল স্টোরের মালিক ইউসুফ জানান, ‘সরকার তো এর আগেও অনেক কিছু বলেছে, তারপরও বাজার নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আমরা কেনার চেয়ে সামান্য লাভ করে তেলসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করি। এবারও সরকার বলছে, রশিদ ছাড়া পণ্য কেনাবেচা করা যাবে না। প্রথমে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মানলেও কয়দিন যাবার পরই আর তারা দিবে না।’
আগে থেকেই রশিদের প্রচলন আছে। তা আবার নতুন করে কার্যকরের ব্যাপারে চানতে চাইলে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘নিয়ম আছে তা মানতে হবে। মানলে কেউ বেশি দাম নিতে পারবে না। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেছেন, ‘কেউ অনিয়ম করলে তাকে শাস্তির আওতায় আসবে হবে। রশিদ প্রথা মানলে ভোক্তারা নায্যমূল্যে পণ্য পাবেন। তাই ব্যবসায়ীদের তা মানতে হবে।’
জেডএ/এসএ/