ভাতা গ্রহণকারীদের সঞ্চয়ে ভাটা
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়ে ভাটা পড়েছে। এই তিন মাসে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সঞ্চয়ের পরিমাণ কমেছে ১১ শতাংশের বেশি। একইভাবে হতদরিদ্রদের প্রায় ২ শতাংশ সঞ্চয় কমেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঞ্চয়ও কম জমা পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, স্বামী পরিত্যাক্তা, বয়স্ক ও বিধবাসহ সামাজিক নিরাপত্তাখাতেও সরকার ভাতা দেওয়ার জন্য ভাতাপ্রাপ্তদের ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থ বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে দশমিক ১৫ শতাংশ। গত জুন মাস পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিলো ৯৭ লাখ ৬ হাজার ৬২১টি। সেপ্টেম্বরে এসে হিসাব সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৭ লাখ ২১ হাজার ৫২৯টি।
কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা খাতে হিসাবের (অ্যাকাউন্ট) সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সঞ্চয় কমেছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। অথচ গত জুন পর্যন্ত এসব ব্যাংক হিসাবে সঞ্চয় জমা পড়েছিল ৯৬৮ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে সঞ্চয় জমা হয়েছে ৮৬১ কোটি টাকা। অবশ্য এই প্রান্তিকে সঞ্চয় কমলেও বছরের ব্যবধানে গড় সঞ্চয় বেড়েছে ২১ দশমিক ১১ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব হিসাবে সঞ্চয় জমা হয়েছিল ৬৬৯ কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মত ১০ টাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাংক হিসাব খোলা অব্যাহত আছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা ৩ লাখ ২২ হাজার ৬৭৬টি ব্যাংক হিসাব খুলেছেন। এসব হিসাবে জমা পড়েছে ৯৫৬ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকে মুক্তিযোদ্ধারা হিসাব খুলেছিলেন ৩ লাখ ২২ হাজার ১৯৮টি। তিন মাসে হিসাবের (অ্যাকাউন্ট) সংখ্যা বেড়েছে মাত্র দশমিক ১৫ শতাংশ।
গত জুন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা ৯৬৪ কোটি টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। আর গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সঞ্চয় করেছেন ৯৫৬ কোটি টাকা। সঞ্চয়ের পরিমাণ কমেছে দশমিক ৭২ শতাংশ। অবশ্য এই প্রান্তিকে সঞ্চয়ের পরিমাণ কমলেও বছরের ব্যবধানে তাদের সঞ্চয় বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা সঞ্চয় জমা করেছিলেন ৬৩৪ কোটি টাকা। মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমানে মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, হতদরিদ্ররাও ১০ টাকার অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ভাতা নেয়। ৩ মাসে এ অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। জুন পর্যন্ত তাদের অ্যাকাউন্ট ছিল ৩২ লাখ ৬১ হাজার ৪০০টি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেড়ে হয়েছে ৩৫ লাখ ৫৪ হাজার ১২৮টি।
তবে ৩ মাসে হতদরিদ্রদের ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) বৃদ্ধি পেলেও সঞ্চয় জমার পরিমাণ কমে হয়েছে প্রায় ২ শতাংশ। জুন পর্যন্ত সঞ্চয় হয়েছিল ২০১ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সঞ্চয় হয়েছে ১৯৭ কোটি টাকা। আর বছরের ব্যবধানে হতদরিদ্রদের সঞ্চয় জমার পরিমাণ কমে হয়েছে ৯ শতাংশের বেশি। অথচ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা সঞ্চয় করেছিলেন ২১৫ কোটি টাকা।
এ ছাড়া, বিশেষ সুবিধার আওতায় কৃষকদের সঞ্চয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। জুন পর্যন্ত তারা ৫৬৯ কোটি টাকা জমা করেছিলেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হয়েছে ৬০২ কোটি টাকা। আর বছরের ব্যবধানে কৃষকের সঞ্চয় বেড়েছে ১৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তারা সঞ্চয় করেছিলেন ৪৮৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গার্মেন্টসকর্মী, চামড়া শিল্পেরকর্মী, স্মল লাইফ ইন্সুরেন্স প্রগ্রামের আওতায় ৫০ ও ১০০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে ২ কোটি ৫৮ লাখ। জুন পর্যন্ত ছিলো ২ কোটি ৫৩ লাখ। ৩ মাসে বেড়েছে ২ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের অ্যাকাউন্ট ছিল ২ কোটি ৪৩ লাখ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বাড়লেও সঞ্চয় কমেছে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা ৩ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা সঞ্চয় করেছেন। জুন পর্যন্ত ছিল ৩ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের উদ্যোগে সবাইকে ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় আনার জন্য ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষকদের ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দেয়। একই বছরে হতদরিদ্রদেরও ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদেরকেও ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া, সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনীর সুবিধাভোগি, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীদের ১০ টাকার বিনিময়ে অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তারা সরকারের ভাতা নেওয়ার সঙ্গে প্রতি মাসে সঞ্চয়ও জমা করছেন।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, সরকার ১০ টাকার অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন সুবিধাভোগীদের ভাতা দেয়। তা থেকেই তারা তাদের অ্যাকাউন্টে কিছু সঞ্চয় করেন। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে বাজেট ক্লোজিং হওয়ায় হয়ত তাদের ভাতা কম জমা হয়েছে। এ ছাড়া, জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য সঞ্চয় কম জমা হয়েছে। তবে পরের কোয়াটারে (প্রান্তিক) তারা আগের মতোই বেশি করে সঞ্চয় জমা করবেন।
অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, কয়েক মাস থেকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যয় মেটাতে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে সুবিধাভোগীদের জীবনে। এ জন্য তারা সঞ্চয় কম জমা করেছে এ প্রান্তিকে। এ ব্যাপারে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। না হলে বৈষম্য আর বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষক, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এরই অংশ বিশেষ তাদের জন্য ২০১১ সালে ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেওয়া হয়। এসব অ্যাকাউন্টের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে হয়ত সঞ্চয় কমেছে।
এনএইচবি/এমএমএ/