৩ বছরে ২৪ হত্যার রহস্যভেদ
ময়নাতদন্তে আত্মহত্যা, পিবিআই তদন্তে হত্যা!
২০১৮ সালের ২৮ জুন। হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয় সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা নূর ইসলামের। ময়নাতদন্ত শেষে দেয়া প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। আদালতের নির্দেশে ২০২১ সালে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তের এক পর্যায়ে তারা জানতে পারে এটি আত্মহত্যা নয়, হত্যাকাণ্ড। সম্প্রতি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রধান আসামি ফারুককে গ্রেপ্তার করে রিমাণ্ডে নেয়া হলে হত্যার দ্বায় স্বীকার করে তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেমিকাকে দিয়ে ডেকে এনে হত্যা করা হয় ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার রামপুরা ইউনিয়নের সদস্য মোনায়েমকে। খুনের পর তার মরাদেহ ঝুলিয়ে দেওয়া একটি গাছে। এ ঘটনায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয় আত্মহত্যা। পুলিশ সেটি আমলে নিয়ে আত্মহত্যা উল্লেখ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনও দাখিল করে। পরে বাদির নারাজীতে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। তদন্তের এক পর্যায়ে দেখা যায় তাকে হত্যার পর গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায়ও সম্প্রতি ৫ জনকে গ্রেপ্তার করলে ৩ জন হত্যার দ্বায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।
শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়। গত ৩ বছরে এ ধরনের ২৪টি হত্যা মামলার তদন্ত উদঘাটন করেছে পিবিআই। সেখানে দেখা গেছে সব ঘটনাতেই আত্মহত্যা বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে একটি ঘটনা ঢাকাতে। বাকিগুলো বগুড়া জেলার শেরপুর, ময়মনসিংহের নান্দাইলে দুটি, ডিএমপির চকবাজার, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, শ্রীপুর মডেল, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর, রংপুর ও গোপালগঞ্জ সদর থানায় দায়ের হওয়া মামলা বলে জানা গেছে। রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থের লেনদেন, তদন্ত কর্মকর্তার গাফলতি ও পক্ষপাতের অভিযোগ রয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই।
ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকেরা বলছেন, জেলাশহরগুলোতে এ ধরনের সমস্যা বেশি হচ্ছে। কারণ জেলায় ময়নাতদন্তের পর ভিষেরা সংরক্ষন করে তা দীর্ঘদিন রেখে দেওয়া হয়। এরাপর আরো কয়েকটি জমা হলে তা ফরেনসিকে পাঠানো হয়। এতে অনেক সময় নিভূল প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হয় না। পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতিরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
২০১৮ সালের ২৮ জুন সিরাজগঞ্জের বেলকুচি ধুকুরিয়া বেড়া পশ্চিপাড়ার একটি পতিত জমি থেকে একই জেলার এনায়েতপুর থানার জালালপুর গ্রামের নূর ইসলামের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত নূর জালালপুর গ্রামের বাসিন্দা হলেও তিনি বেলকুচি থানার মধুপুরে শ্বশুর বাড়িতে বসবাস করতেন। তাঁতের কাজ করতেন টাঙ্গাইলের কালিহাতি এলাকায়। লাশ উদ্ধারের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও পরবর্তীতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালের চিকিৎসক এটি আত্মহত্যা বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেন। পরবর্তীতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আব্দুল আলীম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে ওমর ফারুক, তার বাবা আব্দুর রহমান ও মা নাজমা বেগমকে আসামী করে অভিযোগপত্র দেন।
পরবর্তীতে মামলার বাদি আদালতে নারাজি দিলে আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। মামলার দায়িত্ব নেওয়া পর পুলিশ ১৭ জন স্বাক্ষির সঙ্গে কথা বলেন এবং হত্যা করা হতে পারে বলে ধারনা পান। এরপর পুলিশ ফারুকের সন্ধানে নামে। এক পর্যায়ে ফারুক গত বছরের পহেলা এপ্রিল আদালতে আত্নসমার্পন করলে তাদের দুইদিনের রিমান্ডে আনে পিবিআই। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ফারুক খুনের পর নূর মোহাম্মদকে একটি বরুইগাছে ঝুলিয়ে রাখার কথা স্বীকার করে।
ফারুক পুলিশকে জানায়, সংসারে অশান্তি থাকার কারনে একদিন মন খারাপ করে একটি ফাঁকা মাঠে বসে ছিলেন তিনি। এসময় সেখানে নূর ইসলামের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর ঘটনা জানার পর ফারুককে তাঁতকলে চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাঙ্গাইলে নিয়ে আসে। সেখানে কাজ করার এক পর্যায়ে ফারুকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে নূর ইসলাম। এক পর্যায়ে অতিষ্ট হয়ে ফারুক বাড়ি চলে আসতে চাইলে আত্মহত্যার হুমকি দেয় নূর ইসলাম। এরপর তারা একসঙ্গে গত বছরের ২৭ জুন ফারুকের বাড়িতে যায়। সেখানেও গভীর রাতে ফরুকের উপর যৌন নির্যাতন চালানোর চেষ্টা করলে নূর ইসলামের গলা চেপে ধরে ফারুক। একপর্যায়ে তার শ্বাসবন্ধ হয়ে গেছে বুঝতে পেরে বাড়ির উঠানে বরই গাছের সাথে তার লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর বিষয়টি রাতেই ফারুকের বাবা-মা টের পেয়ে ফারুককে মারধর করে। এক পর্যায়ে ফারুক সব খুলে বললে তারা লাশ নামিয়ে মাঠের একটি পরিত্যাক্ত জায়গায় ফেলে দেয়। এ ঘটনায় লাশ ঘুমে সহায়তার অভিযোগে ফারুকের বাবা-মাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
এরআগে, ২০১৬ সালে রাজশাহীর বোয়ালমারিতে হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল থেকে সুমাইয়া নাসরিন ও তার বন্ধু মিজানুর রহমানের মৃতদেহ পাওয়া যায়। মিজানুরের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল। আর সুমাইয়ার লাশ বিছানায় বালিশ চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল। এ ঘটনায়ও ময়না তদন্তে আত্মহত্যা বলা হয়। তারপর থানা পুলিশ-‘কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায়’ ময়না তদন্তের ওপর ‘ভিত্তি করেই’ আত্মহত্যার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু থানা পুলিশের প্রতিবেদনে আদালত সন্তুষ্ট না হওয়ায় মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআইকে তদন্তের আদেশ দেয়।
পিবিআইয়ের তদন্ত টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বেশ কিছুদিন পর রাজশাহী জেলার পিবিআই তদন্ত করে দেখল ওটা ছিল হত্যাকাণ্ড। ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ওই দুই খুন। সাবেক প্রেমিক ও তার সহযোগী/বন্ধুরা মিলে পরিকল্পিত ভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাদের হোটেলে থাকার খবর পেয়ে সুমাইয়ার সাবেক প্রেমিক ও তার বন্ধুসহ কয়েকজন ওই হোটেলে যান। তারা গোপনে হোটেল নাইসের পাশের একটি ভবনের ছাদ দিয়ে একটু নিচে নেমে হোটেলের জানালা খুলে তাদের কক্ষে ঢুকে। ওই সময় মিজান হোটেলের বাইরে ছিল। আর সুমাইয়া হোটেল রুমে অবস্থান করছিল। তখন অভিযুক্তরা সুমাইয়াকে দিয়ে মিজানকে ফোন করে। মিজান সুমাইয়ার ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি হোটেলে গিয়ে রুমে ঢুকলে অভিযুক্তরা সুমাইয়ার বন্ধু মিজানকে জাপটে ধরে। এরপর হোটেল রুমে সুমাইয়ার সামনে মিজানকে প্রচণ্ড মারপিট করে। একপর্যায়ে রুমের ভিতরে সুমাইয়ার ওড়না নিয়ে মিজানের গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে।
মিজানের লাশ ফেলে রেখে হোটেল কক্ষে অভিযুক্ত রাহাত ও আল-আমিন সুমাইয়াকে ধর্ষণ করে। এরপর তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। দুজনকে হত্যার পর মিজানের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। আর সুমাইয়ার লাশ হোটেলে বিছানায় বালিশ চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল। এ সবই বেরিয়ে এসেছে পিবিআইয়ের তদন্তে। পিবিআই আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৪ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলো, সুমাইয়ার বন্ধু আল-আমিন, বোরহানুল কবির, আহসান হাবিব ও রাহাত মাহমুদ। তারা সবাই ওই সময় ছাত্র ছিল।
ময়নাতদন্তের ভুল এড়াতে চিকিৎসকদের আরো সতর্ক ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন পিবিআইয়ের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, সাধারণত ময়নাতদন্ত হত্যা বা খুনের মামলার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তার উপর নির্ভর করে অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হয়। এ কারনে একাজে যুক্ত চিকিৎসকদের আরো সতর্ক হওয়া জরুরি। একই সাঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তারও গাফলতি রয়েছে।
এনএইচ/