মিয়ানমার থেকে অস্ত্র সহায়তা পাচ্ছে কেএনএফ!
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি বিপথগামী অংশ মিয়ানমারের ইন্ধনে এখানে সশস্ত্র সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়েছে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, অস্ত্র, মাদক, মানবপাচার ও ডাকাতিসহ নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এসব রোহিঙ্গা। স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের প্রতিটি ক্যাম্পেই এসব সন্ত্রাসীর গোপন মিশন রয়েছে। তাদের মদতে প্রায় এক ডজনের মতো সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এ ছাড়াও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠা বান্দরবানের পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফকেও অস্ত্র দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এদের বিরুদ্ধে।
সূত্র মতে, দিন দিন খুন খারাবিতে জড়িয়ে পড়া এসব রোহিঙ্গা এখন বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। তাদের আশ্রয়স্থল কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প এখন পরিণত হয়েছে অপরাধের স্বর্গরাজ্যে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার জেরে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে এসব রোহিঙ্গা।
স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পর মিয়ানমার সরকারের মদতপুষ্ট বিতর্কিত ও কথিত সশস্ত্র সংগঠন আরসার চিহ্নিত সদস্যদের প্রতিরোধের ডাক দিয়ে সম্প্রতি ওই মাদারাসায় একটি সমাবেশ করে প্রত্যাবাসনপ্রত্যাশী সাধারণ রোহিঙ্গারা। সেখানেই বক্তব্য দেন মাদরাসা শিক্ষক হাফেজ ইদ্রিস। এজন্য তিনি ন্যাক্কারজনক এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে বলে ধারণা তাদের।
রোহিঙ্গাদের আরেকটি সূত্রের দাবি, মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের তোপের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কথিত ‘আরসা’র পরিচিত সদস্যরা। তারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে টেকনাফের হ্নীলার নয়াপাড়া মুছনি ক্যাম্পের পাহাড়ি এলাকায় স্থানীয় কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের আশ্রয়ে রয়েছে। ফয়েজউল্লা নামে এক ‘আরসা’র সদস্যকে সম্প্রতি বালুখালী ক্যাম্প থেকে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেয় রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসনপ্রত্যাশী রোহিঙ্গারা একাট্টা হওয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে দেখে ক্যাম্পে বড় ধরনের নাশকতার ছক তৈরি করে দুর্বৃত্ত রোহিঙ্গারা। এরই অংশ হিসেবে মাদরাসায় নারকীয় এই ঘটনা ঘটে বলে দাবি করেছেন তারা।
রোহিঙ্গা নেতা হামিদ হোসেন, মো. ইব্রাহিম ও আবদুস শুক্কুরসহ কয়েকজন সচেতন রোহিঙ্গা দাবি করেছেন- মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড ও ঘুমন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। কথিত আরসার সন্ত্রাসীরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে দাবি করেছেন তারা।
তারা আরও বলেন, প্রত্যাবাসনের বদলে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের অপরাধী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার সরকার। এজন্য তারা বিপথগামী রোহিঙ্গাদের দিয়ে ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
এদিকে, কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অপরাধ দিনে দিনে বাড়ছে। গত চার বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ৩০০ মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৮৭০ রোহিঙ্গা। অপরাধের মধ্যে রয়েছে- হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, অস্ত্র ও মাদক পাচার, মানব পাচার, পুলিশের উপর হামলা ইত্যাদি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চার বছরে ১০০ খুনের মামলা হয়েছে। এসময়ে ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানবপাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতির মামলা হয়েছে। ৩৪টি মামলা হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অপরাধে। অন্যান্য অপরাধে হয়েছে ৮৯টি মামলা।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিওকর্মীদের দাবি, অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরেই অন্তত ১৫-২০টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। এর বাইরে ক্যাম্পকেন্দ্রিক আরও একাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। প্রত্যেক বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন সদস্য রয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের স্বর্গরাজ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পগুলোতে দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি থাকলেও রাতে তা অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়ে।
উখিয়ার রাজাপালং ইউপির কুতুপালং এলাকার সদস্য প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গারা সহজে সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমারে যাওয়া-আসা করতে পারছে। এ কারণে ইয়াবা ও স্বর্ণ চোরাচালান বেড়েছে। আর এসব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে ক্যাম্পকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে অনেক সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। এতে করে খুনাখুনি ও অপরাধের মাত্রা দিনে দিনে বাড়ছে।
অন্যদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদ্য কারামুক্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক কয়েকজন মাদককারবারি জানান, ক্যাম্পে প্রতিদিন শত কোটি টাকার বেশি ইয়াবার লেনদেন হয়। হাতবদল হয় অন্তত ২৫-৩০ লাখ ইয়াবা। মূলত ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে।
ক্যাম্পে ব্যাপকভাবে পরিচিত সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে রয়েছে- মাস্টার মুন্না গ্রুপ, মৌলভী ইউসুফ গ্রুপ, রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আব্দুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, নবী হোসেন বাহিনী, পুতিয়া গ্রুপ, সালমান শাহ গ্রুপ, গিয়াস বাহিনী, শাহ আজম গ্রুপ অন্যতম।
অভিযোগ রয়েছে, ক্যাম্পভিত্তিক বেশিরভাগ সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের যোগাযোগ রয়েছে। ক্যাম্প অশান্ত করতে সন্ত্রাসী গ্রুপকে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা ফ্রিতে দিচ্ছেন দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী। মূলত বিশ্বে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরা, আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্ব করতে চায় মিয়ানমার।
১৯৭৮ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানের পর দেশে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। সবমিলিয়ে দেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে। বাকিরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, সীমান্ত এলাকা বাদ দিয়ে শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অপরাধবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে। কক্সবাজারের ইতিহাসে ইয়াবার সবচেয়ে বড় চালান জেলা পুলিশ জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। দায়িত্বে না পড়লেও আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে বান্দরবানের সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকেও অস্ত্রসহ নানা ধরনের সহায়তার অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে এই সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর একের পর এক হামলা করছে। তাদের হামলায় হতাহতের ঘটনাও বাড়ছে। অভিযোগ উঠেছে, কেএনএফের সন্ত্রাসীরা মিয়ানমার থেকে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা পাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে অর্থাৎ পাহাড়ের ভেতরে অঘটন ঘটিয়ে তারা মিয়ানমারে পালিয়ে যাচ্ছে। আবার সুযোগ মতে তারা ভেতরে প্রবেশ করছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে এই সন্ত্রাসীরা পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে নানা সহায়তা পাচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটনায় আমরা নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছি। দ্রুত অভিযানও শুরু হবে।
এসএন