ফারদিন হত্যা: বাবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
সন্তান হত্যার বিচার নিয়ে উদ্বিগ্ন বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের বাবা নূর উদ্দিন রানা। তিনি জানান, পারিবারিকভাবে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংকটে আছেন।
তিনি বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে চেয়ে আছি। তাদের প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। কিন্তু র্যাব পুলিশ এক এক সময় এক এক কথা বলছেন। এদিকে আমাদের সন্তান নেই অন্যদিকে মিডিয়ায় আজে বাজে তথ্য আসছে, সব কিছু মিলে আমরা পারিবারিকভাবে অস্বস্তিতে আছি।
ফারদিনের বাবা আরও বলেন, আমার ছেলে হত্যার ঘটনায় সন্দেহের তালিকায় রেখে বুশরাকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। তবে যদি বুশরা অপরাধী না হয়ে থাকে তাহলে সন্দেহের তালিকা থেকে বুশরার নাম বাদ দেওয়া উচিত। এই ঘটনার তদন্তের তেমন অগ্রগতি দেখছি না। পুলিশ-র্যাব ভালো-মন্দ কোনোটিই বলছে না। আমাদের দাবি হলো অবিলম্বে এই হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচন করা হোক। দেশবাসী জানুক আসল ঘটনা কী বা কারা অপরাধী। আর অপরাধীদের আমরা শাস্তি চাই।
এদিকে বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এই হত্যার পর উল্টো ভুক্তভোগী নিজেই বিভিন্ন সমালোচনার শিকার হয়েছেন। র্যাব ও পুলিশ ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিচ্ছে। এ নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবার ও সাধারণ জনগণের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ফারদিন হত্যা নিয়ে র্যাব-পুলিশের ভিন্ন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুটো সংস্থার তদন্তের মধ্যে তেমন কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের একটি তদন্ত বলছে, তিনি মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে খুন হন এবং নিজেও মাদক সেবন করতেন। পুলিশের এমন ধারণা মেনে নিতে নারাজ ফারদিনের পরিবার। এরপর র্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, ফারদিন মাদকে আসক্ত ছিলেন না। মাদকের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
এসব তদন্তের বিষয় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করেছে নিহত ফারদিনের পরিবার। এক প্রশ্নের জবাবে ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বলেন, র্যাব-পুলিশ দুই ধরনের কথা বলছে। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা কার কথা বিশ্বাস করব। তাদের দুই ধরনের তথ্যে হতাশ হয়ে পড়েছি আমরা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার মনে হচ্ছে এই দুই বাহিনীর তদন্তের সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, র্যাব-পুলিশকে চোখ কান খোলার রেখে যেকোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে হবে। দেশের মানুষ হয়তো ফারদিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভুলে যাবে, তবে এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বুশরাকে তারা মনে রাখবে। পুলিশ একটি ছবি দিল আর মিডিয়াতে সেটা প্রচার হলো। বুশরার একটা জীবন আছে। কেউ অপরাধী হয়ে জন্ম নেয় না।
তৌহিদুল হক বলেন, ফারদিন হত্যার তদন্ত নিয়ে এক এক সময় এক এক ধরনের বিশ্লেষণ দেওয়া হচ্ছে। সামান্য তথ্য-প্রমাণ পেলেই সেটা মিডিয়াতে প্রকাশ করা হচ্ছে। এতদিন হয়ে গেল ফারদিন হত্যাকাণ্ডের কেউ গ্রেপ্তার হলো না। শুধু গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছে সে খুন হয়েছে এটাই শুনে যাচ্ছি। আসামিকে না ধরে মিডিয়ায় দুই বাহিনীর বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে সাধারণ মানুষ আইনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার।
তিনি আরও বলেন, ফারদিন একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। তিনি যে পরিবারে বড় হয়েছেন পরিবার যদি তার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য শোনে তাহলে পরিবারের মন খারাপ হয়। একদিকে তাদের সন্তান নেই অন্যদিকে উল্টাপাল্টা কথা শুনতে হচ্ছে। তারা বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা হারাতে শুরু করেছে। কাজেই র্যাব-পুলিশকে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য গণমাধ্যমে না দেওয়ার অনুরোধ করছি। এই হত্যার সঙ্গে সরাসরি অভিযুক্ত যারা তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি দাঁড়ানোর কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সামান্য তথ্য-প্রমাণ পেয়ে সেগুলো মিডিয়াতে প্রচার বা অপপ্রচার না করে অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্যে ফারদিন হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনার শিকার হয়েছে। তাদের প্রমাণ করতে হবে তারা যেটা বলছে সেটা সঠিক কি না। আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধার রয়েছে। সেই জায়গা থেকে সতর্কতার সঙ্গে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করাটায় হলো তাদের প্রধান কাজ।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এই হত্যা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আমরা প্রায় শনাক্ত করতে পেরেছি। চনপাড়ার আশেপাশে হত্যাকাণ্ডটি ঘটছে এটা আমরা নিশ্চিত। ফারদিনকে হত্যায় সরাসরি জড়িত রয়েছে রায়হান গ্যাং এর সঙ্গে আরও ১০-১৫ জন। সবাইকে একসঙ্গে আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ফারদিনের সঙ্গে নারীঘটিত ও মাদকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করছি যাতে নিরাপরাধ মানুষ কোনো হয়রানির শিকার না হয়। সেই জন্য ছায়া তদন্তে থেকে কাজ করছে র্যাব।
ডিবি পুলিশের প্রধান মো. হারুন অর রশীদ ঢাকাপ্রকাশ-কে মুঠোফোনে বলেন, আমাদের গোয়েন্দা টিম এই হত্যার ঘটনায় মাঠে থেকে কাজ করছে। অপরাধীদের আমরা আইনের আওতায় আনার কাজ করছি। তদন্ত চলমান।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বুশরার বিষয়ে আমাদের তদন্ত কাযর্ক্রম অব্যাহত। বুশরাকে গ্রেপ্তার করার কারণ হলো ফারদিনের বাবা তাকে অভিযুক্ত করে মামলা করেছে।
এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানিয়েছে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে তারাবোর দিকে যেতে দেখা গেছে ফারদিনকে। সাদা গেঞ্জি পরা তিন-চারজন ফারদিনকে লেগুনায় উঠিয়ে নিয়ে তারাবোর দিকে যায়। সেই লেগুনার চালক ও সহকারীকে খুঁজছেন তারা কিন্তু এখনো পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, গত ৫ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন। ওইদিনই রাজধানীর রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা নূর উদ্দিন। পরে নিখোঁজের দুদিন পর গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিন নূর পরশের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। এরপর তার বাবা বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
কেএম/এসএন