গৃহবধুকে হত্যার ১৭ বছর পর স্বামীর বোন-দুলাভাই গ্রেপ্তার
যৌতুকের টাকা না পেয়ে ঢাকার ধামরাইয়ে সামিনা নামে এক গৃহবধূকে নির্যাতন ও পুড়িয়ে হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গ্রেপ্তাররা হলেন, আব্দুর রহিম (৬৪) ও রোকেয়া বেগম (৫০)। তারা সম্পর্কে হত্যার শিকার সামিনার স্বামী জাফরের বড় বোন-দুলাভাই। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সোমবার (২২ আগস্ট) র্যাব-৪ এর একটি দল চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ থানার নারায়ণপুর গ্রাম থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর সোমবার রাতে রোকেয়া ও রহিমকে গ্রেপ্তার হয়। তবে এখনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরও ৩ আসামি পলাতক রয়েছেন বলে জানায় র্যাব।
মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার আব্দুর রহিম আদালতের রায়ের পর থেকে ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকায় পেশা পরিবর্তন করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। রোকেয়া আত্মগোপনে থেকে গার্মেন্টসে চাকরি করে আসছিল। তবে একই গার্মেন্টেসে তিনি বেশি দিন চাকরি করতেন না।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও মামলার এজহারের বরাতে র্যাব-৪ অধিনায়ক বলেন, ২০০৩ সালে সাভারের কাউন্দিয়া নিবাসী সামিনার সঙ্গে বক্তারপুরের জাফরের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে কন্যাপক্ষ সাধ্য অনুযায়ী নগদ টাকা, আসবাসপত্র এবং ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী দেয়। কিন্তু স্বামী জাফর বিয়ের পর থেকেই যৌতুক হিসেবে আরও টাকার জন্য স্ত্রী সামিনার ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকেন।
একসময় জাফর সামিনাকে বাবার বাড়ি থেকে ১৬ হাজার টাকার আনার জন্য চাপ দিতে থাকেন। পরে সামিনার দরিদ্র বাবা জুরা মিয়া ছয় হাজার টাকা দেন। বাকি টাকার জন্য জাফর, জাফরের বোন রোকেয়া ও তার স্বামী আব্দুর রহিমসহ অন্য আসামি সামিনাকে শারীরিকভাবে নির্যাতনসহ মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকেন। টাকা এনে দেওয়ার জন্য সামিনার মুখে সিগারেটের আগুন দিয়েও নির্যাতন করেন জাফর। এর মধ্যে জাফর তার বোনকে ১০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন।
ঘটনার দিন ২০০৫ সালের ৭ জুন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সামিনাকে ফুসলিয়ে রোকেয়া-রহিম দম্পতির ধামরাই থানাধীন সৈয়দপুরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জাফর যৌতুকের বাকি টাকা দাবি করলে সামিনা জানান, তার বাবা আর টাকা দিতে পারবেন না। এ কথা শুনেই জাফর সবার সামনে সামিনাকে শারীরিক নির্যাতন শুরু করেন। মারধরের একপর্যায়ে দাহ্য পদার্থ ঢেলে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যান। সামিনার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে নয়ারহাট গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নেন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ জুন তার মৃত্যু হয়। তবে মৃত্যুর আগে এ ঘটনায় জড়িত সবার নামসহ ঘটনার জবানবন্দি নেয় পুলিশ।
নিহতের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি অনুযায়ী জাফরকে মূল অভিযুক্ত করে জাফরের বড় ভাই জাহাঙ্গীর, সালেক, জাফরের বড় বোন রোকেয়া ও তার স্বামী আব্দুর রহিম এবং জাফরের মামা ফেলানিয়াসহ মোট ৬ জনকে আসামি করে ধামরাই থানায় একটি মামলা দায়ের করেন সামিনার মা নাজমা বেগম ।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষে ভিকটিমের পরিবারকে আদালতে এ মামলা পরিচালনা সহায়তা দেওয়া হয়।
২০০৫ সালের ৩১ আগস্ট তদন্ত শেষে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সব আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। ২০১৮ সালের ৫ জুলাই ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নং-৯ এর বিচারক জাফর, জাহাঙ্গীর, সালেক, রোকেয়া, আব্দুর রহিম ও ফেলানিয়াকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এছাড়া প্রত্যেক আসামিকে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডেরও আদেশ দেন। ঘটনার পর জাহাঙ্গীর ছাড়া এ মামলার সব আসামি গ্রেফতার হয়। মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জাফর আগে থেকে জেলহাজতে রয়েছেন। সালেক ও জাফরের মামা ফেলানিয়া মামলা চলাকালীন গ্রেফতার হয়ে এক বছর কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান। বর্তমানে তারা পলাতক।
গ্রেপ্তার আব্দুর রহিম ১১ মাস ও রোকেয়া ১৭ মাস কারাভোগের পর ২০০৬ সালের শেষের দিকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আত্মগোপনে চলে যান। রায়ের সময় শুধুমাত্র জাফর আদালতে হাজির ছিলেন, বাকি আসামিরা পলাতক ছিলেন।
গ্রেপ্তার আব্দুর রহিম রায়ের পর থেকে ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকায় পেশা পরিবর্তন করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। কখনো তিনি তালা মেরামত, কখনো বাবুর্চির হেলপার আবার কখনো শরবত বিক্রি করতেন। এমনকি বিভিন্ন মাজারের কর্মী হিসেবে আত্মগোপনে থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন তিনি। তিনি কখনই এক জায়গায় দীর্ঘদিন বসবাস করতেন না। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত আর কখনই নিজ বাড়িতে ফিরে যাননি।
রোকেয়া মূলত গার্মেন্টস কর্মী। ঘটনার পর থেকে তিনি আত্মগোপনে থেকে গার্মেন্টসে চাকরি করে আসছিরেন। তবে একই গার্মেন্টেসে তিনি বেশি দিন চাকরি করতেন না। ২০১৭ সালে বয়স কমিয়ে, অবিবাহিত দেখিয়ে নতুন এনআইডি কার্ড করেন। গৃহকর্মী হিসেবে কৌশলে সৌদি আরব পাড়ি জমান। গত ৫ বছর দেশের বাইরে ছিলেন। গত জুনের প্রথমদিকে দেশে ফেরেন তিনি।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
কেএম/এএস