রজব আলী হত্যা: ১১ বছর পর ফাঁসির আসামি গ্রেপ্তার
পূর্ব শত্রুতার জেরে রাজধানীর কোতোয়ালি থানাধীন নবাবপুরে চাঞ্চল্যকর রজব আলী হত্যাকান্ডের মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১১ বছরের পলাতক আসামি মো. জিকু (৩২) কে মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
মঙ্গলবার (৯ অগাস্ট) রাতে র্যাব-৩ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল তাকে গ্রেপ্তার করে। র্যাব জানিয়েছে, পলাতক জিকু প্রায় ৮ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরারি জীবন যাপন করছে।
আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব-৩ জানায়, নিহত রজব আলী জিকুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। কিন্তু ভিকটিমদের বাসা ছিল লালচাঁন মোকাল্লেম পাড়ায় এবং আসামি জিকুর বাসা ছিল রায়সাহেব বাজার এলাকায়। তারা পরস্পর বন্ধু হলেও এলাকা ভিত্তিক উঠতি বয়সের যুবকদের মধ্যে গ্রুপিং ছিল। জিকুরা দুজনেই মাদকাসক্ত ছিল। মূলত মাদকের কারণে এই হত্যাকাণ্ডে ঘটনাটি ঘটে।
বুধবার (১০ আগস্ট) র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, নিহত ব্যক্তি এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দল বেধে মাদক সেবন করতেন। একদিন মাদক সেবনের সময় তাদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। তখন ভিকটিম রজব আলী তাদের মাদক সেবন সঙ্গী সজিব নামে একজনের মোবাইল জামানত রেখে মাদকের টাকা সংগ্রহ করে দল বেধে মাদক সেবন করে। পরবর্তীতে জামানতের টাকা পরিশোধ না করেই তারা ভিকটিমের নিকট জামানত দেওয়া মোবাইলটি দাবি করেন। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়। শত্রুতার জের ধরে রায়সাহেব পাড়া এলাকার ছেলেরা জিকুর নেতৃত্বে রহিম ওরফে আরিফ, আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে টাইগার, মন্টি, মো. মিলন ওরফে চোপা মিলন, আকাশ ওরফে রাসেল, ফরহাদ হোসেন ওরফে ফরহাদ, সজিব আহমেদ খান, শহীন চাঁন খাদেম ও মোহাম্মদ আলী হাওলাদার বাবু ভিকটিম রজব আলীকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করে।
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১১ সালের ২৪ জুলাই রাতে রাজধানীর কোতোয়ালি থানার নবাবপুরে মোবাইলের দোকানে ভিকটিম রজব আলী টাকা রিচার্জ করতে গেলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জিকুসহ আরও ৪-৫ জন রজব আলীকে ঢাকা জজ কোর্টের পিছনে ১৬ নং কোর্ট হাউজ স্ট্রিটের পূর্ব পাশে নিয়ে যায়। সেখানে পূর্ব থেকে ওৎ পেতে থাকা চোপা মিলন, আকাশ, ফরহাদ, সজিব, শাহীন চাঁন খাদেমসহ সকলে মিলে রজব আলীর উপর এলোপাতাড়ি আক্রমণ করে বুকে ও পেটে ছুরিকাঘাত করলে রজব আলী রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সে সময় রজব আলী চিৎকার করলে চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে এলে তারা সকলে পালিয়ে যায়। রজব আলীকে গুরুতর আহত অবস্থায় পথচারীরা প্রথমে নিকটস্থ ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঐ ঘটনায় রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় রজবের ভাই জুম্মন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলার পর গ্রেপ্তারকৃত আসামি আত্মগোপনে চলে যান।
তিনি আরও বলেন, এরপর ২০১২ সালে ৫ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগ পত্র জমা দেয়। আদালত ১৮ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর ১ আগস্ট ২০১৯ সালে মামলার রায় ঘোষণা করেন। ওই রায়ে জিকু, রহিম ওরফে আরিফ ও আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে টাইগারকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এরপর আসামিরা সকলেই পলাতক হয়। এছাড়াও একই রায়ে ৭ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ৩ জনকে খালাস প্রদান করা হয়।
র্যাব জানায়, আসামির পেশা মটর মেকানিকস। সে ১০ বছর বয়স হতে ধোলাইখাল এলাকায় ওয়ার্কশপে কাজ শিখে। এবং প্রাইভেটকারের যেকোন যান্ত্রিক ত্রুটি সহজেই শনাক্ত করে মেরামত করতে পারে। তার মাসিক আয় প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা। কিন্তু সে ১৪ বছর বয়সেই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। তার রোজগারের দুই তৃতীয়াংশ সে মাদকের পিছনে ব্যয় করে। প্রতিদিন পারিশ্রমিক পাওয়ার পরই সে মাদক ক্রয় করে। যেদিন রোজগার বেশি হয় সেদিন সে বেশি পরিমানে মাদক সেবন করে। ২০০৭ সালে সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তার ২ জন কন্যা ও ১ জন পুত্র সন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী বর্তমানে দুবাই প্রবাসী। তার সন্তানেরা শ্বশুরবাড়ি বরিশালে রয়েছে।
র্যাব বলছে, গ্রেপ্তারকৃত আসামির মাদক সেবন করা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মাদকই তার জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে। ২০১১ সালের ২৪ জুলাই হত্যাকান্ডের ঘটনার দিন তারা সকলে মিলে ভিকটিম রজব আলীকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ ঘটনায় রজব আলী মৃত্যু বরণ করলে ঘটনার পরপরই আসামি মাতুয়াইল এলাকায় জনৈক মনুমিয়ার বাড়িতে আত্মগোপনে চলে যায়। দীর্ঘ আট মাস পলাতক থাকার পর সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাছে আটক হয়ে তিন বছর ছয় মাস জেল খাটে। জেল থেকে জামিনে বের হওয়ার পর সে বরিশাল তার শ্বশুরবাড়ি চলে যায় এবং কোর্টে হাজিরা দেওয়া হতে বিরত থেকে পলাতক জীবন যাপন শুরু করে। সেখানে নিজেকে মটর মেকানিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ওয়ার্কশপে কাজ করে। পরবর্তীতে তার কোন এনআইডি না থাকায় সে নিজের নাম পরিবর্তন করে নাসির উদ্দিন নামে নিজেকে পরিচয় দেয়।
মটর মেকানিকের কাজ জানায় সে অতি সহজেই কর্মস্থল পরিবর্তন করতে পারত উল্লেখ করে র্যাব-৩ অধিনায়ক বলেন, সে প্রাইভেটকারের যেকোন যান্ত্রিক ত্রুটি সহজেই শনাক্ত করে মেরামত করতে পারে। এজন্য যেকোন ওয়ার্কশপে তার নাম পরিচয় যাচাই না করেই চাকুরি পেয়ে যেত। এভাবে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর সে আবার ঢাকায় ফিরে আসে। সে লম্বা চুল ও দাড়ি রেখে বেশ বদল করে নাসির উদ্দিন পরিচয়ে ধোলাইখাল এলাকায় একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতে শুরু করে। পলাতক সময়ে সে তার সকল নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখে। ওই সময়ে তার মাদকাসক্তির পরিমান আরও বাড়তে থাকে। তার রোজগারের সমস্ত টাকাই সে মাদকের পিছনে ব্যয় করতে থাকে। এরপর তার ওয়ার্কশপের এক সহকর্মীর পরামর্শে সে মুন্সীগঞ্জের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হয়। নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হওয়ার পর তাদের চিকিৎসার অংশ হিসেবে জিকুর চুল ও দাড়ি কেটে দেয়। এভাবেই তার আসল চেহারা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে প্রকাশ পায় এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।
গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
কেএম/এএস