ফেসবুকে কিডনি কেনাবেচা, শিকার নিম্নআয়ের মানুষ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি কেনাবেচার সংঘবদ্ধ চক্রের অন্যতম হোতাসহ চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) রাজধানীর ভাটারা, বনশ্রী ও মিরপুর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
বুধবার (২০ জুলাই) দুপুরে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সব তথ্য জানান র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমিন।
গ্রেপ্তাররা হলেন- সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা মো. শহিদুল ইসলাম মিঠু (৪৯), মো. মিজানুর রহমান (৪৪), মো. আল মামুন ওরফে মেহেদী (২৭), মো. সাইমন (২৮) ও মো. রাসেল হোসেন (২৪)।
র্যাব জানায়, এ চক্রটি প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য রোগী প্রতি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতো। যে সব নিন্মআয়ের মানুষ কিডনি বিক্রি করত তাদের চার লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে দুই লাখ টাকা দিয়ে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দিত।
র্যাব বলছে, প্রতারণার মাধ্যমে মানবদেহের কিডনিসহ নানাবিধ অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি চক্র। এসব চক্রের ফাঁদে প্রলুব্ধ হয়ে অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ ক্ষেত্র বিশেষে গ্রাহকরাও প্রতারিত হচ্ছে। আইনবহির্ভূত, স্পর্শকাতর ও অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের এমন কার্যক্রমে চক্রের সদস্যরা অর্থের লোভে অমানবিক কাজে যুক্ত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব সাইবার মনিটরিং সেল ভার্চ্যুয়াল জগত তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবৈধভাবে কিডনিসহ অন্যান্য মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় সিন্ডিকেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আসছিল। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা অনলাইনে বিভিন্ন প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাহক ও ডোনারদের আকৃষ্ট করে থাকেন।
ইতোপূর্বে র্যাবের অভিযানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি কেনাবেচা চক্রের অন্যতম হোতা ও ফেসবুক পেজের এডমিনসহ চক্রের পাঁচ সদস্যকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। একই সঙ্গে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেন্দ্রিক কিডনি কেনাবেচার অন্যান্য চক্রগুলোকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সাইবার মনিটরিং ও গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করেছে সংস্থাটি।
র্যাব-১ জানায়, এসময় অভিযানে কিডনি কেনাবেচা চক্রের সদস্যদের কাছে বিভিন্ন ভিকটিমের চুক্তির এফিডেভিট কপি, ভুক্তভোগীদের পাসপোর্টসহ মোট ১৪টি পাসপোর্ট, কিডনি ক্রসম্যাচিং এর বিভিন্ন দলিলাদি, দেশি ও বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফটোকপি, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই ও এটিএম কার্ড, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের জাল সিলমোহর, খালি স্ট্যাম্প, সিপিইউ, মোবাইল ও সিমকার্ড জব্দ করা হয়।
র্যাব কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মোমিন বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি কেনাবেচা এই চক্রের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। তারা মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কিডনি বেচাকেনার অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এই চক্রের সদস্যরা পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানরত কিডনি কেনাবেচা সদস্যদের চক্রের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রায় শতাধিক মানুষকে পাচার করেছে বলে জানা যায়।
চক্রের ১ম গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। চক্রের ২য় দলটি ১ম দলের চাহিদা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এর জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ৩য় গ্রুপটি প্রলোভনের শিকার ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রত্যাশী রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য পরীক্ষা নিরিক্ষা সম্পন্ন করে।
ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে, তার পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ভুক্তভোগী ডোনারকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে। এই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র পারস্পরিক যোগসাজশে ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারকে বিদেশের এয়ারপোর্ট অথবা স্থলবন্দরে রিসিভ করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, অস্ত্রপাচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ভিকটিমদের বৈধ/অবৈধ উপায়ে বিমান বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠায়।
অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমিন আরও বলেন, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, এ চক্রের মূলহোতা ও অন্যতম অভিযুক্ত মো. শহিদুল ইসলাম মিঠু ২০১৬ সালে নিজের চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশে যান। সেখানে অবস্থানকালীন তিনি কিডনি প্রতিস্থাপনের রোগীদের ব্যাপক চাহিদা দেখতে পান এবং তিনি নিজেই কিডনি প্রতিস্থাপনের অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা শুরু করেন। তার মাধ্যমে ৫০ এর অধিক কিডনি ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে মর্মে তিনি প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন। গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
কেএম/আরএ/
