স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির প্ররোচনায় আত্মহত্যা করেন এলমা
স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির অসৌজন্যমূলক আচরণ ও মারপিট সহ্য করতে না পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী এলমা চৌধুরী আত্মহত্যা করেছেন। এমনি তথ্য উঠে এসছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি তদন্তে।
পুলিশ বলছে, আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা অনুযায়ী ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
এ ঘটনার প্রায় চার মাস পর চূড়ান্ত তদন্তের বরাত দিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) বলছে, এ মামলার প্রতিবেদন যেকোনো সময় আদালতে জমা দেওয়া হবে। তদন্তে জানা যায়, নিহতের প্রবাসী স্বামী ইফতেখার আবেদীন (৩৫) কানাডা থেকে দেশে ফেরার তিন দিনের মাথায় তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
তদন্তে জানা যায়, ফ্রান্সে থাকাকালে নিহতের স্বামী ইফতেখার প্রথম বিয়ে করেন। এ সংসারে একটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। ২০২০ সালে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ইফতেখারের বিচ্ছেদ হয়। পরে একটি মাধ্যমে এলমার সঙ্গে ইফতেখারের পরিচয় হয়। পরিচয়ের ৮ দিনের মাথায় গত বছরের ২ এপ্রিল ইফতেখার-এলমার বিয়ে হয়। এলমার বিয়ের পর ইফতেখার কানাডায় চলে যান। কথা ছিল, তিনি এলমাকেও কানাডায় নিয়ে যাবেন। কানাডায় নিয়ে না যাওয়ায় এলমার সঙ্গে মাঝে মাঝে তার স্বামীর ঝগড়া হতো।
ডিবি পুলিশের তদন্তের একটি সূত্র বলছে, প্রবাসী স্বামী ইফতেখার আবেদীন ও এলমা চৌধুরীর মধ্যে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস কম ছিল। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে সাংসারিক ঝামেলা তৈরি হতো।
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর এলমার (২৬) মৃত্যু হয়। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের দাগ ছিল। এ ঘটনায় এলমার মৃত্যুর এক দিন পর তার বাবা সাইফুল রাজধানীর বনানী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় এলমার স্বামী ইফতেখার আবেদীন, শাশুড়ি শিরিন আমিন ও শ্বশুর মো. আমিনকে আসামি করা হয়। এই তিনজন পারস্পরিক যোগসাজশে এলমাকে হত্যা করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
এ মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ১৪ ডিসেম্বর ইফতেখার জানান, এলমা গুরুতর অসুস্থ। তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। স্ত্রী ও ভায়রাকে সঙ্গে নিয়ে সেদিন বিকাল ৫টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছান নিহতের বাবা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি হাসপাতালের ট্রলিতে এলমার মরদেহ দেখতে পান। মরদেহের পাশে ছিলেন ইফতেখার ও তার বাবা মো. আমিন। এ সময় তাদের আচার-আচরণ স্বাভাবিক ছিল না।
মামলায় নিহতের পিতা সাইফুল অভিযোগ করেন, বিয়ের পরপরই ইফতেখার ও তার বাবা-মা এলমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চান। তাতে রাজি না হওয়ায় তারা এলমার চুল কেটে দেন। সাংসারিক নানা কাজের জন্যও এলমার ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হতো।
সুরতহাল প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সাইফুল মামলার এজাহারে লেখেন, এলমার নাকে, ওপরের ঠোঁটে, ঘাড়ে, গলার উপরিভাগে থুতনিতে, পিঠের ডান পাশে, দুই হাতে, দুই পায়ের বিভিন্ন জায়গায় জখমের কালচে দাগ ছিল। এ ছাড়া তার বাম কানে আঘাত ছিল। দুই হাতের আঙুল কাটাছেঁড়া ছিল। পায়ের বুড়ো আঙুল ছেলা ছিল।
এলমার লাশের ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন ও টক্সিকোলজি বিভাগের প্রভাষক ফারহানা ইয়াসমীন। তিনি লিখেছেন, মৃত্যুর ধরন বলছে, এলমা আত্মহত্যা করেছেন। ঝুলে থাকায় শ্বাসরোধে তিনি মারা যান। তবে তার শরীরের নানা জায়গায় আঘাতের অসংখ্য দাগ রয়েছে।
এলমার মৃত্যুর পরপরই তার স্বামী ইফতেখারকে গ্রেপ্তার করে বনানী থানা পুলিশ। পরে মামলাটির তদন্তভার পায় ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইফতেখারকে চার দফায় রিমান্ডে নেয় ডিবি। তদন্তের অংশ হিসেবে তারা এলমার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনসহ অন্যান্য আলামত ও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান ঢাকা প্রকাশকে বলেন, এলমা আত্মহত্যা করেছেন আমরা সবাই শুনেছি, কিন্তু তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছে স্বামী ইফতেখার আবেদীন। এ ছাড়া আমরা জানতে পেরেছি তার শাশুড়ি শিরিন আমিন, শ্বশুর মো. আমিনও আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এলমা বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করেছে। তিনি বলেন, কাউকে আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচনা দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, এ বিষয়টি ডিজিটাল-ফরেনসিক প্রমাণের পাশাপাশি আসামি ও অন্য সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও অনেক বিষয় থেকে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।
কেএম/টিটি