যেভাবে জঙ্গি হামলার শিকার হুমায়ুন আজাদ
লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই।
১৮ বছর আগে এই দুই জঙ্গি নেতার নির্দেশে আতাউর রহমান সানির নেতৃত্বে মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ, আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহীদ, নূর মোহাম্মদ ওরফে শামীম, হাফিজ মাহমুদসহ অন্যরা হুমায়ুন আজাদকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করেন।
মামলার নথি, অভিযোগপত্র ও দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে এই তথ্য জানা গেছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া দুই আসামি হলেন মিজানুর ও আনোয়ারুল।
দুই আসামির স্বীকারোক্তির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে অমর একুশে বইমেলায় হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ প্রকাশিত হয়। বই আকারে প্রকাশের আগে উপন্যাসটি একটি জাতীয় দৈনিকের ঈদসংখ্যায় ছাপা হয়। তখন জঙ্গিরা ঈদসংখ্যাটি সংগ্রহ করে শায়খ আবদুর রহমানের নজরে আনেন। তিনি উপন্যাসটি পড়ে হুমায়ুন আজাদকে হত্যার নির্দেশ দেন।
২০০৪ সালে ‘আগামী প্রকাশনী’ থেকে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনী।
ওসমান গনী আদালতকে বলেন, ‘২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে বাসায় যাই। পরে টেলিফোনে প্রথমে সংবাদ পাই, হুমায়ুন আজাদ স্যারকে মেরে ফেলা হয়েছে। পরে শুনি, স্যার মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। এই সংবাদ শোনার পর আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে যাই। তখন হুমায়ুন আজাদ স্যারকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পাই।’
২০০৪ সালের বইমেলায় ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি ব্যাপক বিক্রি হয় বলে জানান ওসমান গনী। তিনি আদালতকে বলেন, ‘বইটি ইত্তেফাক পত্রিকাতেও বের হয়। তখন মৌলবাদীরা মিছিল করে বইটি নিষিদ্ধের দাবি জানায়। মৌলবাদীরা হুমায়ুন আজাদকে মুরতাদ ঘোষণা করে। তাকে হত্যার হুমকি দেয়। আমাকেও তারা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চিঠি পাঠায়।’
মামলার অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে সানির নেতৃত্বে মিজানুর একটি চাপাতি, জেএমবির কিলিং স্কোয়াডের সদস্য নূর মোহাম্মদ ছুরি, আনোয়ারুল ও নুরুল্লাহ বোমা নিয়ে অবস্থান করছিলেন।
হুমায়ুন আজাদ রাত সোয়া ৯টার দিকে বইমেলা থেকে বের হয়ে হেঁটে টিএসসির দিকে যেতে থাকেন। বাংলা একাডেমি ও টিএসসির মাঝামাঝি অবস্থানে পৌঁছালে সানির নেতৃত্বে তাঁর সহযোগীরা হুমায়ুন আজাদকে ঘেরাও করে ফেলেন।
মিজানুর ও নূর মোহাম্মদ ব্যাগ থেকে চাপাতি-ছুরি বের করে হুমায়ুন আজাদের ঘাড়, মাথা, মুখ, গলা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি আঘাত করেন। এ সময় আনোয়ারুল ও নুরুল্লাহ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়ান। এভাবে হামলাকারীরা সাধারণ লোকজনের সঙ্গে মিশে যান। রাত ১১টার দিকে শায়খ আবদুর রহমানকে এই ঘটনা মুঠোফোনে জানানো হয়।
আদালতে দেওয়া আনোয়ারুলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অনুযায়ী, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হুমায়ুন আজাদকে হত্যাচেষ্টার আগে বাংলা ভাই দিনাজপুরে যান। সেখানে তিনি আনোয়ারুলকে নূর মোহাম্মদের মুঠোফোন নম্বর দেন।
পরে ঢাকায় আনোয়ারুলের সঙ্গে মিজানুর, সানি ও নুরুল্লাহর দেখা হয়। সানি তখন আনোয়ারুল ও নুরুল্লাহকে বলেন, ‘তোমরা আজকে আমাদের সঙ্গে একটা কাজে যাবে। তোমাদের কাজ হবে নূর মোহাম্মদ ও মিজানুরকে অনুসরণ করা। তাঁদের কাজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোমা ফাটিয়ে নিরাপদে তাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে।’ পরে তারা রিকশায় করে বইমেলায় যান।
নূর মোহাম্মদ ও মিজানুরের ব্যাগে চাপাতি-ছুরি ছিল। নুরুল্লাহর ব্যাগে তিনটি বোমা ছিল। বইমেলার গেটের বিপরীত পাশে একটা চটপটির দোকানে তাঁর অপেক্ষা করছিলেন।
রাত সোয়া ৯টার দিকে সানি ইশারা দিয়ে হুমায়ুন আজাদের পিছু নিতে বলেন। তখন নূর মোহাম্মদ ও মিজানুর চাপাতি-ছুরি বের করে হুমায়ুন আজাদকে কোপাতে শুরু করেন। রাস্তার লোকজন চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলে বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মিজানুর বলেছেন, ‘আমরা জানতে পারি, বইমেলা থেকে প্রতিদিন রাত ৮টা বা সাড়ে ৮টার দিকে হুমায়ুন আজাদ হেঁটে বাসায় যান। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সেদিন আমিসহ অন্যরা বাংলা একাডেমিতে যাই। রাত সোয়া ৯টায় হুমায়ুন আজাদ যখন বইমেলা শেষে বাসায় ফিরছিলেন, তখন আমরা তাঁর পিছু নিই।’
জবানবন্দিতে মিজানুর আরও বলেন, ‘হুমায়ুন আজাদকে আমি ও নূর মোহাম্মদ ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করি। তখন দূরে থাকা লোকজন ছুটে এলে আনোয়ারুল একটা বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। তখন লোকজন বিক্ষিপ্তভাবে পালাতে থাকে। আমরাও পালিয়ে যাই। রাত ১১টার দিকে মোবাইল ফোনে শায়খ আবদুর রহমানকে এই ঘটনা জানাই।’
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করতে জেএমবির সামরিক কমান্ডার সানিকে নির্দেশ দেন শায়খ আবদুর রহমান।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয়। তাকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। পরদিন তার ভাই মঞ্জুর কবির রাজধানীর রমনা থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। বিদেশে উন্নত চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর একই বছরের ১২ আগস্ট জার্মানিতে মারা যান হুমায়ুন আজাদ। এরপর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।
মামলাটি তিন বছর তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ১৪ জানুয়ারি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়ে জখম করার পর ঘটনাস্থলে যান দৈনিক জনতার ফটো সাংবাদিক ইফতেখার উদ্দিন। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আদালতে ইফতেখার বলেন, “রক্তাক্ত অবস্থায় হুমায়ুন আজাদ স্যারের ছয় থেকে সাতটি ছবি তুলি আমি। এ সময় স্যারের জ্ঞান ছিল। তিনি বলছিলেন, ‘আমার চশমা দাও। গাড়ি ডাকো। আমি একাই হাসপাতালে যেতে পারব।’ তখন টহল পুলিশের গাড়িতে করে স্যারকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। স্যার বলেছিলেন, ‘ওরা সন্ত্রাসী। ওরা জঙ্গি। বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাবে।’”
হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার আরেক সাক্ষী সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে তিনি আদালতকে বলেন, ‘সেদিন মুক্তপ্রাণ উৎসবের গান শুনছিলাম। রাত সাড়ে ৯টার দিকে হঠাৎ টায়ার ফাটার মতো বা বোমার শব্দ শুনি। তখন আমি শব্দের উৎসস্থলের দিকে যেতে থাকি।’
বাবা হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে সাক্ষ্য দেন হুমায়ুন আজাদের মেয়ে মৌলি আজাদ। তিনি আদালতকে বলেন, ‘আমার পিতা একজন প্রথাবিরোধী লেখক। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মুক্তিবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি কোনো দলাদলিতে ছিলেন না। সমাজের বাস্তবতা নিয়ে তিনি নিজে যা বুঝতেন, তাই প্রকাশ করতেন। এ দেশের ধর্মীয় উগ্রবাদী-মৌলবাদীদের দৈনন্দিন ও পূর্বাপর কীর্তিকলাপ নিয়ে তিনি স্পষ্টভাবে লিখতেন। প্রচার ও প্রকাশনা করতেন।’
এসএ/