'আব্বু আমাদের মা কখন আসবে?'
রাজধানীর সবুজবাগে ঘরে ঢুকে দুই শিশু সন্তানের হাত-পা বেঁধে মাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এসময় শিশুদের শরীরেও আঘাত করে ঘাতকেরা। রক্তমাখা অবস্থায় পড়েছিল ছোট শিশু দুটি।
ওই শিশু দুটির নাম- মায়মুনা জাহান (মেয়ে), তার বয়স ৪ বছর। আর ছোট বাচ্চাটার নাম তানভীরুল ইসলাম (ছেলে), তার বয়স মাত্র দশ মাস। খুনিরা এই চার বছরের শিশু ও ১০ মাসের শিশুটিকে আঘাত করে। তাদের চোখের সামনে মাকে হত্যা হতে দেখে তারা কান্নাকাটি করে। এ কারণে ঘাতকেরা বাচ্চা দুটিকে আঘাত করে এবং মুখ বেঁধে রাখে।
পুলিশ জানায়, এ ঘটনাটি সংগঠিত হওয়ার পর পাশের বাড়ির এক নারী প্রথমে জানতে পারেন। পরে স্থানীয় লোকজন ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশকে খবর দেন।
আরও পড়ুন: ঘরে ঢুকে দুই সন্তানের সামনে মাকে কুপিয়ে হত্যা
সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের স্বামী মো. মাইনুল ইসলাম একটি মামলা করেন। সেই মামলায় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
দুর্বৃত্তদের হাতে মাকে খুন হতে দেখে ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শিশু দুটি। ওই সময় তাদের সাহায্য সহযোগিতা করার মত আশেপাশে কেউ ছিলনা। খুনিরা যখন তাদের মাকে হত্যা করে তখন শিশু দুটি চিৎকার চেঁচামেচি করে এতেও খুনিদের হৃদয়ে একটুও মায়া হয় না। বরং তারা ক্ষিপ্ত হয়ে খুব কম বয়সী ওই বাচ্চা দু'টোকে আঘাত করে এবং তাদের মুখ বেঁধে রাখে।
খুনের পর দুর্বৃত্তরা শিশু দুটিকে ওই বাসায় বেঁধে রেখে চলে যায়। মা মারা যাওয়ার পর শিশু দুটি অসহায় হয়ে পড়ে। পাশের বাসার একটি মহিলা ওই বাসার দরজা কয়েকবার নক করে। কিন্তু ভিতর থেকে তেমন কোনো সাড়া আসেনা। বিষয়টি ওই মহিলার সন্দেহ হলে স্থানীয় কিছু লোকজন ডেকে ঘরের দরজা ভেঙে শিশু দুটিকে উদ্ধার করে এবং সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।
স্থানীয় লোকজন জানান, ঘাতকেরা মাকে হত্যার পর অবুঝ শিশু দুটিকে নির্মম ভাবে আঘাত করে। তাদেরকে বেঁধে রাখার কারণে তারা ভয়ে নিথর হয়ে যায়। এলাকার লোকজন বলেন, যখন দরজা ভেঙে বাসায় প্রবেশ করা হয় তখন ওই শিশু দুটি সাধারণ মানুষের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। তারা জানে না যে তাদের মা আর পৃথিবীতে নেই। সে সময় বাচ্চা দুটি প্রচন্ড ভয়ে ছিল।
এ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে শিশুটির বাবা মো. মাইনুল ইসলাম বলেন, আমার সন্তানরা এতিম হয়ে গেল। জীবনে এমন ঝড় আসবে কখনো ভাবতে পারিনি। ওই ঘটনার পর আমার সন্তানরা স্বাভাবিকতা হারায়।
তিনি বলেন, আমার মেয়েটা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছে। ওদের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতে পারিনা। আমার কান্না আসে। মা ছাড়া শিশুসন্তান দুটি বড় হবে কিভাবে এমন নানান প্রশ্ন জাগে আমার? শিশু দুটির মুখের দিকে তাকালে আমার বুকটা ফেটে যায়। এত ছোট বয়সী শিশু কিভাবে ওরা বড় হবে? আর বড় হয়ে ওরা যখন শুনবে ওদের মা এভাবে মারা গেছে তখন ওই বিষয়টি ওরা কিভাবে নিবে? আমি ওদের নিয়ে চিন্তিত। আমার বড় মেয়েটা সে অনেকটা উৎফুল্ল ও চঞ্চল ছিল। ওইদিনের ঘটনার পর থেকে ভয়ে ও আর চঞ্চলতা দেখায় না। শুধু বারবার আমাকে বলে আব্বু আমার মা কোথায়, মা কখন আসবে, মাকে এনে দাও।
তিনি বলেন, এমন ঘটনা যেন কারো জীবনে না ঘটে। আমার মেয়েটা রাতের বেলায় মাঝেমাঝে মা মা বলে চিৎকার করে। আর বলে আব্বু মা কখন আসবে আমি মায়ের কাছে ঘুমাবো। প্রতিদিন আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার মা কোথায় গেছে মাকে এনে দাও? তখন আমার বুকটা ফেটে যায়। আমি বলি তোমাদের মা আসবে আম্মু। এতোটুকু ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে আমার অভিনয় করতে হচ্ছে।
সরকারি মেডিক্যাল কলেজের টেকনিশিয়ান মাইনুল কাজ করতেন ঢাকার মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেই কারণে সবুজবাগ এলাকার বেগুনবাড়ি মাস্টার গলির চারতলা ভবনের দোতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। পাঁচ মাস আগে ফরিদপুর মেডিক্যাল থেকে বদলি হয় তার। স্ত্রী মোসা. তানিয়া আফররোজ, ৪ বছরের মেয়ে আর ১০ মাসের ছেলেকে ঢাকায় রেখেই ফরিদপুরে কাজ করতেন মাইনুল। হঠাৎ এ দুঃসংবাদ শুনে ঢাকায় চলে আসেন। গত সপ্তাহের শনিবার সন্ধ্যায় অন্যদিনের মতোই কাজে থাকার সময় ফোন পান যে তার স্ত্রী মারা গেছেন। এরপরই ঢাকার দিকে ছুটতে থাকেন তিনি। পথেই জানতে পারেন, তার স্ত্রীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, তিনি খুন হয়েছেন।
ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য বাপ্পী নামের একজন এসি (শীতাতাপ যন্ত্র) টেকনিশিয়ানকে সন্দেহ করে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। পরে এই ঘটনার মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর খুনিরা আদালতে তাদের স্বীকারোক্তি দিয়েছে এবং খুনের কথা স্বীকার করেছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে সবুজবাগ থানার ওসি মোরাদুল ইসলাম বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের পর ৪ বছরের শিশু মেয়েটি পাশের বাড়িতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেয়। এটা একটি মর্মান্তিক হত্যাকান্ড। স্ত্রী হারানোর পাশাপাশি দুই সন্তানকে নিয়ে এখন উদ্বেগে দিন কাটছে মাইনুলের।
সবুজবাগ থানার ওসি মোরাদুল বলেন, ১০ মাসের ছোট শিশুটি তিনদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। হাসপাতাল থেকে ছাড়ার পর নিয়ে গেছে তার এক চাচা। ওই শিশুটির মুখেও স্কচটেপ প্যাঁচানো ছিল। এতেও শিশুটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ঘাতকেরা শিশু দুটির সামনে নির্মমভাবে তাদের মাকে হত্যা করে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওসি তদন্ত বলেন, এ ঘটনার পর আমরা থানা পুলিশ যখন সেখানে যাই গিয়ে দেখি বাচ্চা দুটি থরথর করে কাঁপছে। পাশের বাসার লোক প্রথমে ঘটনাটি বুঝতে পারে এবং বাচ্চা দু'টোকে উদ্ধার করে পরে ৯৯৯ এ ফোন করে।
বাচ্চা দুটির খোঁজ খবর রাখেন তারা কেমন আছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাচ্চা দুটো ভালো আছে। রংপুরে বাবার কাছে আছে। এঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা আদালতে হত্যার ঘটনা স্বীকার করেছে। এখনও মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে।
কেএম/কেএফ/