৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চেতনা মাল্টিপারপাস, চক্রের ১০ সদস্য গ্রেপ্তার
ঢাকা জেলার সাভার-আশুলিয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এ অভিযোগে লাপাত্তা ‘চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের’ সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান র্যাব।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, ইকবাল হোসেন সরকার, মাজহারুল ইসলাম, মমিন হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, ইব্রাহিম খলিল, এস এম মকবুল হোসেন, মিজানুর রহমান, আল আমিন হোসেন, ফজলুল হক ও নুর হোসেন।
র্যাব জানায়, মুনাফার লোভে অনেকেই নিজেদের পেনশনের টাকা, গ্রামের ভিটেবাড়ি বিক্রি করা টাকা ও বিদেশ থেকে কষ্ট করে অর্জিত টাকা ওই প্রতিষ্ঠানে জমা রাখতেন। ২০০৮ সালে কার্যক্রম শুরুর পর এভাবে অন্তত এক হাজার পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৩০০ কোটি টাকা।
মঙ্গলবার (২২ মার্চ) বিকেল ৫টা থেকে দিবাগত রাত ১টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে র্যাব-৪ এর একটি দল আশুলিয়া এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত নগদ অর্থ, মোবাইল ফোন ও ব্যাংক চেকসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
বুধবার (২৩ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজ্জাম্মেল হক।
ডিআইজি মোজ্জাম্মেল হক বলেন, আশুলিয়ায় জামগড়া এলাকার ‘চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানটি এক হাজার পরিবারের ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা র্যাবকে জানান, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট গভর্নিং বডি নিয়ে ‘চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্থানীয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও স্বল্পআয়ের মানুষদের অধিক মুনাফায় সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণের প্রতি আকৃষ্ট করতেন তারা। ধীরে ধীরে এই সংস্থার বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে।
তিনি বলেন, একই সঙ্গে চেতনা মাল্টিপারপাস আরও বড় পরিসরে কাজ করা শুরু করে। তাদের মূল টার্গেট ছিল আশুলিয়া ও সাভার এলাকার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার। তাদেরকে অতি উচ্চ মুনাফা প্রদানের আশ্বাসে কোম্পানিতে সঞ্চয়ী পলিসি, এফডিআর, ডিপিএস, পেনশন পলিসি, শিক্ষা পলিসি, হজ পলিসি ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী পার্টনার পলিসিতে আকৃষ্ট করতেন।
আসামিদের বরাত দিয়ে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজ্জাম্মেল হক বলেন, সাধারণ সঞ্চয়ী পলিসিতে ১৮ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ হারে মুনাফা এবং ফিক্সড ডিপোজিটের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ বছরের দ্বিগুণ মুনাফা প্রদানের আশ্বাসে হাজারেরও অধিক পরিবারকে সমিতিতে টাকা জমা রাখতে উৎসাহিত করতেন তারা।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বিশ্বাস অর্জনের জন্য সংস্থাটি গ্রহীতাকে প্রথম দিকে কয়েক মাস চুক্তি অনুযায়ী লভ্যাংশ প্রদান করত। যা দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হতেন। অনেকে নিজের পেনশনের টাকা, গ্রামের ভিটেবাড়ি বিক্রি করা টাকা, বিদেশ থেকে কষ্ট করে অর্জিত অর্থ ওই সংস্থায় উচ্চ মুনাফা লাভের আশায় জমা রাখেন। এভাবে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গত ১৬ মার্চ অফিস তালা দিয়ে লাপাত্তা হন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সংস্থাটির অংশীদাররা বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে জায়গা-জমি কেনা, বহুতল ভবন নির্মাণ ও ছোট-বড় কারখানা করেছেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে বিভিন্নভাবে অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন তারা।
র্যাব জানায়, এ প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে বেশ কিছু ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। তদন্তের মাধ্যমে তাদের নাম-পরিচয় এবং প্রতারণায় কার কী ভূমিকা তা বেরিয়ে আসবে। সাভার উপজেলা সমবায় কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন মাসে সর্বশেষ অডিট অনুযায়ী এই সমিতির ফান্ডে মাত্র ৬১ লাখ টাকা জমা ছিল।
তিনি বলেন, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য তারা ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কথা প্রচারণা চালাতেন। যদিও তাদের বিধি মোতাবেক কোনো ইসলামি শরিয়াহ বোর্ড ছিল না। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জায়গা সমিতির নামে রেজিস্ট্রেশনের কথা থাকলেও তা মূলত পলাতক সভাপতি মুহাম্মদউল্লাহ, তাজুল ইসলাম ও অজ্ঞাত নামে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এছাড়াও ২০ হাজার টাকা মাসিক কিস্তিতে ফ্ল্যাট বিক্রি, দিনাজপুরের কাহারুলে সভাপতির নামে ১৬ বিঘা জমি থাকলেও তা বিক্রির চেষ্টা চলছে।
ডিআইজি মোজ্জাম্মেল হক বলেন, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের কোনো অনুমোদন না থাকলেও ব্যবসায়ীদের উচ্চ সুদে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করতো প্রতিষ্ঠানটি। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং মারধর করতেন তারা। সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ করা টাকা নিজেদের নামে সরিয়ে কমিটির কর্মকর্তারা নিজেদের নামে-বেনামে ফ্ল্যাট ও প্লট, বাগান, আবাদি জমি এবং বিভিন্ন ব্যাংকে নগদ টাকা লেনদেন করেছেন।
চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারা আরও তিনটি নামসর্বস্ব কোম্পানি চালু করেন। সেগুলো হলো- চেতনা পরিবার, চেতনা গার্ডেনিয়া (রিয়েল এস্টেট ব্যবসা) এবং চেতনা পরিবার কল্যাণ ফাউন্ডেশন। তবে চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ছাড়া বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
কমিটির সহ-সভাপতি পলাতক মুহাম্মাদউল্লাহ আশুলিয়ার নরসিংহপুরে বসবাস করলেও তিনি মূলত ভোলার বাসিন্দা। তিনি ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। আশুলিয়াতে তার পাঁচতলা বাড়ি এবং একাধিক ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার ইকবাল হোসেন সরকার মুহাম্মাদউল্লাহর বন্ধু ও সমিতির সহ-সভাপতি।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা চলমান রয়েছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
কেএম/