হিন্দু-মুসলিম জটিলতায় ৬ দিন ধরে মর্গে নারী সাংবাদিকের মৃতদেহ
ছবি: সংগৃহীত
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হন এক নারী সাংবাদিক। কর্মক্ষেত্রে সবাই তাকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে জানলেও তার নাম বৃষ্টি খাতুন এবং তাকে তাদের মেয়ে বলে দাবি করছেন এক দম্পতি। এ নিয়েই তৈরী হয়েছে জটিলতা। তিনি হিন্দু নাকি মুসলিম, বৃষ্টি নাকি অভিশ্রুতি। এই ঘটনার জট খুলতেই তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া জন্য পরিচয়দানকারী মা-বাবার ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে।
যার কারণে ৬ দিন ধরে ওই নারী সাংবাদিকের নিথর দেহ পড়ে আছে মর্গে। তার মরদেহের অপেক্ষায় দিন পার করছেন দাবিকৃত মা-বাবা ও স্বজনরা।
বৃষ্টি খাতুন দাবি করা শাবুরুল আলম সবুজ ওরফে সবুজ শেখ বলেন, সিআইডি অফিস থেকে এখনো ডিএনএ রিপোর্ট দেয়নি। রিপোর্ট আসার পরে পুলিশ মরদেহ বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে। তাই অপেক্ষায় আছি। এখন আমি রমনা থানায়। বৃষ্টি আমার মেয়ে। হস্তান্তর করলে আমরা মেয়ের মরদেহ নিয়ে কুষ্টিয়ার খোকসায় গ্রামের বাড়ি যাব এবং সেখানেই দাফন সম্পন্ন করব।
বৃষ্টির মা বিউটি বেগম ও তার খালা সাবানা খাতুন বলেন, বৃষ্টির মরদেহ পাওয়ার অপেক্ষায় আমরা ঢাকায় আছি। আমার মেয়েকে নিয়ে আমরা বাড়ি যাব। কিন্তু ডিএনএ রিপোর্ট হয়নি। এজন্য আমাদের মরদেহ দেওয়া হচ্ছে না। বৃষ্টি খাতুন আমার মেয়ে। মেয়ের মরদেহের অপেক্ষায় প্রতিটি রাত নির্ঘুম কাটছে।
শাবুরুল আলম সবুজ ও বিউটি বেগম দম্পতির দাবি, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামের ওই সাংবাদিকের আসল নাম বৃষ্টি খাতুন। সে ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বনগ্রাম গ্রামের পশ্চিমপাড়ায়। তার বাবার নাম শাবুরুল আলম সবুজ ওরফে সবুজ শেখ এবং মায়ের নাম বিউটি বেগম।
অন্যদিকে ওই সাংবাদিককে তার সহকর্মীরা অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে চিনতেন, ফেইসবুকেও তার ওই নামই পাওয়া যায়। মন্দিরে গিয়ে পূজা-অর্চনাও করতেন বলে জানা গেছে। এমনকি ওই সাংবাদিকের চাকরির আবেদন পত্রে দেখা গেছে, তার বাবার নাম লিখেছেন অভিরূপ শাস্ত্রী এবং মায়ের নাম লিখেছেন অপর্ণা শাস্ত্রী। সেখানে তিনি নিজের বর্তমান ঠিকানা লিখেছেন সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, মৌচাক।
বৃষ্টি খাতুনের স্বজনরা বলেন, মেয়ের মৃত্যুর পর থেকে বৃষ্টির মা-বাবার কান্না থামছে না। মেয়েকে হারানোর ব্যাথা-বেদনায় পাগলপ্রায় তারা। এর মধ্যে নানান জটিলতা তৈরি হয়েছে। বৃষ্টির সবকিছু ঠিক আছে। তবুও ডিএনএ টেস্ট করা হচ্ছে। নমুনা নিয়েছে কিন্তু রিপোর্ট আসেনি। মেয়ের মরদেহ পাওয়ার জন্য তার বাবা কখনো রমনা থানায়, কখনো মর্গে, কখনো সিআইডি অফিসে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, রিপোর্ট ডট লাইভ ছেড়ে সম্প্রতি কেস্টারটেক নামে একটি অনলাইন মাল্টিমিডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেওয়া তুষার হাওলাদারের সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন অভিশ্রুতি। ওই ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ গেছে মোট ৪৬ জনের মধ্যে অভিশ্রুতি আর তুষারও রয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস তার মরদেহ উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মর্গে রাখে।
এরপর শুক্রবার (১ মার্চ) অভিশ্রুতিকে নিজের মেয়ে বৃষ্টি বলে দাবি করেন সবুজ শেখ। পরে রমনা কালি মন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহা রমনা থানায় লিখিতভাবে দাবি করেন মেয়েটি সনাতন ধর্মের, তার নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। তার বাড়ি ভারতে। শাস্ত্রী বিভিন্ন সময় কালিমন্দিরে এসে পূজা করতো। এতেই মরদেহ নিয়ে তৈরি হয় ধূম্রজাল। ফলে ডিএনএর মাধ্যমে তার পরিচয় শনাক্তের প্রয়োজন রয়েছে। এ কারণে ওই নারী সাংবাদিকের মরদেহ তার বাবার কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। ৬ দিন ধরে মর্গে পড়ে আছে তার মরদেহ।
তার পরিচয় নিশ্চিত হতে রোববার বাবা পরিচয়দানকারী শাবরুল আলম সবুজের নমুনা ও সোমবার দুপুরে মা পরিচয়দানকারী বিউটি বেগমের ডিএনএ-এর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এখনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।
শাবুরুল আলম সবুজ বলেন, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামের সাংবাদিকই আমার মেয়ে বৃষ্টি। ছোটবেলা থেকে তার ডাক নাম বৃষ্টি খাতুন। গ্রামে নাম বৃষ্টি, স্কুলে নাম বৃষ্টি, কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজে যখন পড়েছে, তখনও তার নাম বৃষ্টি। সে ঢাকাতে ঢাবি সাত কলেজের অধীনে ইডেন কলেজে দর্শনে পড়াশোনা করেছে। তার রোল নম্বর ২৭৬। সেই সব কাগজেও তার নাম বৃষ্টি। সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রীই আমার মেয়ে বৃষ্টি।
অভিশ্রুতি বা বৃষ্টির জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, ইডেন কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার প্রবেশপত্রে নাম বৃষ্টি খাতুন রয়েছে। ২০২১ সালের ৬ জুলাই ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম বৃষ্টি খাতুন হিসাবেই রয়েছে। সেখানে বাবার নাম সবুজ শেখ এবং মায়ের নাম বিউটি বেগম রয়েছে। কলেজের প্রবেশপত্রেও তার একই রকম তথ্য আছে। ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর ইস্যু করা জন্ম নিবন্ধন সনদে নাম অভিশ্রুতি লেখা হলেও বাবার নাম লেখা হয়েছে মো. শাবুরুল আলম এবং মায়ের নাম বিউটি বেগম।