‘আমি মার কাছে যামু’
‘আমি মার কাছে যামু, আমার মা কই? বাবা কই। তারা আমার কাছে আসছে না কেন। তারা কি আমাকে দেখবো না? তাদেরকে আসতে বলো। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এভাবেই বিলাপ করছে ছয় বছরের শিশু শাকিরা আক্তার মিষ্টি। সে এখনো জানে না, তার মা-বাবা ও নানা আর বেঁচে নেই। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শাকিরা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সোমবার (২৪ জানুয়ারি) বিকেলে ঢামেক হাসপাতালের ২০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ১০ নম্বর বেডে গিয়ে দেখা যায় মামি সোনিয়া পারভীন মনি ও তার বোন শিরিন সুলতানা শাকিরার দেখভাল করছেন। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুটিকে কোলে নিয়ে শিরিন সুলতানা সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে নিয়ে যান। এই ফাঁকে তিনি শাকিরাকে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলে মা-বাবার কথা ভুলানোর চেষ্টা করেন। তার পরেও হঠাৎ হঠাৎ কান্না করে আর মা-বাবার কথা বলে কেঁদে উঠছে শিশুটি। বলতে থাকে ‘আমি মার কাছে যামু, আমার মা কই?
মামি সোনিয়া জানান, দুর্ঘটনার কথা তার কিছুই মনে নেই। তাকে আর মনে করাতেও চাই না। সে বাচ্চা মানুষ, শুধু একটু পর পর বলছে মা কই? আমি মায়ের কাছে যাব। তখন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি তোমার নানু অসুস্থ, তোমার মা নানুর কাছে আছে। তখন সে বলে আমি বাড়ি যাব, আমার মায়ের কাছে যাব। আজকে হঠাৎ বলছে, মামাকে আসতে বলো আমাকে নতুন জামা কিনে দিবে। শাকিরার মা-বাবা ও নানার মরদেহ নিয়ে পরিবারের অন্যান্য সবাই বাড়ি গেছেন দাফনের জন্য। শাকিরাকে দেখভালের জন্য আমি আছি। সাভার থেকে আমার বড় বোন এসেছে।
তিনি আরও জানান, শিশুটির সিটি স্ক্যান থেকে শুরু করে যাবতীয় সব পরীক্ষা হাসপাতালের পরিচালক ফ্রি করে দিয়েছেন। শাকিরা শুক্রবার মধ্য রাতে ঘুম থেকে উঠে বলছে আমার বুক ব্যথা করে, পেট ব্যথা করে।
শাকিরার বড় ভাই শাহরিয়া ফাহিম (১১) কয়েক দিন আগে গ্রাম থেকে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল মামা আনভীর আহমেদের বাসায় বেড়াতে আসে। ঘটনার সময় সে মামার বাসায় ছিল। শাকিরার বাবা গ্রামে একটি এনজিওতে চাকরি করতেন। তিনি আরও জানান, মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে শিশুটির নানী সাহেদা বেগম চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাকেও জানানো হয়নি তার স্বামী, মেয়ে ও মেয়ের জামাই মারা গেছেন।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক জানান, কিছুক্ষণ পরপরই শিশুটির খবর নেওয়া হচ্ছে। তার লোকজনদের বলা হয়েছে কোনো সমস্যা হলেই যেনো সরাসরি আমাকে জানায়। শিশুটি শঙ্কামুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। সব রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে আবার চিকিৎসকরা বিস্তারিত জানাবেন।
হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের চিকিৎসক মোস্তফা আল মামুন বলেন, শিশু শাকিরার পাঁজরেরহাড় ভেঙ্গে গেছে। আমরা তার চিকিৎসা করে যাচ্ছে। সে সুস্থ্য হলেই তাকে ছেড়ে দিবো।
এদিকে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম জানান, এ দুর্ঘটনায় শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) রাতেই থানায় একটি মামলা হয়েছে (মামলা নম্বর ১০০)। সেন্টমার্টিন পরিবহনের ঘাতক বাসটি জব্দ করা হয়েছে। সেটা রাজধানীর আরামবাগ থেকে কক্সবাজার লাইনে চলাচল করে। শনিবার চালক ও চালকের সহকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
উল্লেখ্য, শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) সকাল ৭টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানাধীন মাতুয়াইল মা ও শিশু হাসপাতাল সামনে রাস্তায় একটি বাসের ধাক্কায় সিএনজি চালিত অটোরিকশার চালকসহ ৫ জন আহত হন। পরে পাঁচ জনকে আহতাবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক একই পরিবারের তিন জনকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতরা হলেন: আব্দুর রহমান (৬৫), তার মেয়ে শারমিন আক্তার (৩৫) এবং শারমিনের স্বামী মো. রিয়াজুল (৪৫)। আহত হয়েছেন শারমিনের মেয়ে শাকিরা মিষ্টি (৬) ও অটোরিকশা চালক মো. রফিক (৪২)।
এএইচ/