‘হঠাৎ বিকট শব্দ, কোনোমতে প্রাণে বেঁচে গেছি’
ঠিক সকাল ১০টা বেজে ৫০ মিনিট। এমন সময় বিকট এক শব্দ। মনে হয়েছে কোথাও বড় ধরনের বোমা ফেটেছে। এমন সময় দোকান থেকে বের হয়ে দেখি আমাদের ভবনের উপরের ফিনিক্স লাইফ ইনস্যুুরেন্স এর ৩ তলা থেকে শুধু ধোঁয়া বের হচ্ছে। তখন আমার মনে হলো এসি থেকে ধোঁয়া আসছে।
রবিবার (৫ মার্চ) রাজধানীর সায়েন্সল্যাবের ভবনটিতে বিস্ফোরণের পর এভাবেই ঘটনার ভয়বহতার বর্ণনা করছিলেন ধসে পড়া ভবনের নিচ তলার দোকানদার আব্দুল রাজ্জাক।
দোকানদার আব্দুল রাজ্জাক বলেন, ‘নিজে হয়তো পালিয়ে বেঁচে গেছি কিন্তু অন্য মানুষেরা তো আর দৌড়াতে পারেনি। এজন্য আমি আবার ফিরে এসে তাদের সাহায্য করেছি। আজ আমার কান্না আসছে এমন একটি ঘটনা চোখের সামনে দেখে।’
তিনি বলেন, ‘আমার চোখের সামনে ভবনটি বিস্ফোরণ হয়ে মুহূর্তে তছনছ হয়ে যায়। এ সময় একজন ডাবের দোকানদার ও শসা বিক্রেতা রাস্তায় ছিল। তারা এই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদেরকে আমার এক লোক হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে কয়েকজনের অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক ছিল। পরে শুনতে পারলাম তিনজন মারা গেছেন আর তিনজনের অবস্থা খুবই খারাপ।’
গাউছিয়া মার্কেট ও প্রিয়াঙ্গন শপিং কমপ্লেক্সের পাশের ভবনের ঠিক অপজিটে দাঁড়িয়ে ছিলেন আইসক্রিম বিক্রেতা জয়নাল মিয়া। তিনি বলেন, তার কাছে মনে হলো সোয়া ১১টার দিকে এই ঘটনাটি ঘটে। হঠাৎ বিকট শব্দ কানে আসে, পরে চিৎকার আর চেঁচামেচি। মানুষের চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি একটি ভবনে বিস্ফোরণ। কয়েকজন মানুষ বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। ‘কয়েকজনকে বাঁচাতে অন্যদের মতো আমিও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলাম’।
ধসে যাওয়া ভবনের ওপর থেকে ইটের সঙ্গে একজন মানুষ ছুটে নিচে পড়ে যায়। তাকে আহত অবস্থায় পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যান মেহেদী হাসান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, এত বিকট শব্দ আমি আগে কখনো শুনিনি। আহত ওই ব্যক্তির শরীরে ইটের আঘাত আর সিমেন্টের ছাফ রয়েছে।।
বিকট শব্দে দৌড়ে রাস্তা আরেক পাশে আশ্রয় নেন পথচারী সাব্বির হোসেন। এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ভবনটির সামনেই দাঁড়ানো ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে ভবন থেকে ইট-সিমেন্ট আমার শরীরে এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড় দিয়ে রাস্তার ওপাশে চলে যাই। ঘটনাস্থল এর আশেপাশের রাস্তায় যারা দাঁড়ানো ছিল তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। মনে করছিলাম আজ আমিও শেষ। আল্লাহ কোনোভাবে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’
‘শিরিন ম্যানশন’ নামের ভবনটির তিন তলায় ছিল ফিনিক্স ইনস্যুরেন্স কোম্পানির একটি শাখা। সেখানে ছয় জন কাজ করছিলেন। তারা সবাই আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অফিসের ইনচার্জ আকবর, আশরাফ, আশা, স্বপ্না ও জোহুর হাফিজ শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন।
এ ছাড়া, আরেকজনকে ভর্তি করা হয়েছে ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতালে। জোহুর হাফিজ বাদে বাকি সবাই গুরুতর আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ফিনিক্স ইনস্যুরেন্স কোম্পানির জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহবুব সোবহান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অফিসে তেমন দাহ্য পদার্থ ছিল না। দুই টন করে চার টনের দুটি এসি ছিল। শুনতে পারলাম প্রথমে এসি বিস্ফোরণ হয়েছে। এ ছাড়া এর বেশি কিছু বলতে পারি না। আশেপাশে মানুষের কাছ থেকে এটাই শুনেছি। এ ছাড়া আমরা এখন পর্যন্ত আর কিছু জানতে পারিনি।’
এদিকে ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিট। তারা প্রায় সবাই একই ধরনের কথা বলেছেন।
ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালনরত রমনা জোনের ডিসি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, কীভাবে এই ঘটনাটি ঘটেছে তা ভালোভাবে এখনো বলা যাচ্ছে না, তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, সায়েন্সল্যাব এলাকার ভবন বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা নয়, এটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র। বিস্ফোরণের ঘটনাটি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত কমিটি ফায়ার সার্ভিস এবং ঘটনাস্থলে কাজ করা এক্সপার্টদের ওপিনিয়ন (মতামত) নিব। পরে তারা একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। প্রাথমিকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আমার মনে হয়েছে এটি নাশকতা নয়, দুর্ঘটনা থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষজ্ঞরাও এটি নিয়ে কাজ করছেন।
বিস্ফোরণের কারণে বিল্ডিংয়ের অবস্থা এখন পর্যন্ত খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘কয়েকটি কারণে এই ঘটনাটি ঘটতে পারে। সব বিষয়ে আমলে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বেশ কয়েকটি কারণে এখানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। একটি হলো শর্ট সার্কিট, জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও এসি বিস্ফোরণও হতে পারে। তবে এই মুহূর্তে সঠিক কারণ বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষ হলে সঠিক কারণ জানা যাবে।’
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেছেন, এসি বিস্ফোরণ ও গ্যাসের লাইন থেকে এই ঘটনাটি ঘটেছে হয়তো। তদন্তের পর সবকিছু জানা যাবে।
অন্যদিকে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের ইনচার্জ রহমতুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, সুয়ারেজ লাইনের গ্যাস জমা হয়ে সায়েন্সল্যাবের ভবনটিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, সাইন্সল্যাব এলাকার ভবন ধসে যাওয়ার ঘটনায় কাজ করছেন সেনাবাহিনীর বোম ডিসপোজাল ইউনিট। রবিবার (৫ মার্চ) বিকালে সাড়ে তিনটার দিকে সেনাবাহিনীর একটি বোম ডিসপোজাল ইউনিট ঘটনাস্থলে আসে এবং ভেঙে যাওয়া ভবন পর্যবেক্ষণ করেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সেনাবাহিনীর ৫৭ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কমান্ডিং অফিসার মেজর মো. কায়সার বারী বলেন, শিরিন ম্যানশনের তৃতীয় তলায় ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণের ঘটনায় বিস্ফোরক কোনো দ্রব্য ব্যবহারের আলামত পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, যেহেতু আমরা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক ব্যবহারের কোনো আলামত পায়নি, আরও তদন্ত শেষে পরবর্তী সময়ে জানা যাবে বিস্ফোরণটি আসলে কেন ঘটেছে।
কেএম/এমএমএ/