ঢামেক হাসপাতালের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে বাইরে, রোগীরা বঞ্চিত
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে রোগীদের জন্য সরকার থেকে সরবরাহকৃত ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, সুতা, গ্লাভস বাইরে পাচার করে দিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা হলো হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তারা আবার লোকজনের মাধ্যমে বাইরে বিক্রি করছে এসব ওষুধ।
এই সিন্ডিকেটের গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে ধরা পড়ে চুনুপটুরা। যারা ধরা পড়ে তাদের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে কিন্তু তদন্তের প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখে না। এইভাবে চলছে সিন্ডিকেটদের বাণিজ্য।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ঢামেক হাসপাতাল থেকে সরকারি ইনজেকশন বাইরে বিক্রির চেষ্টাকালে ইসমাইল হোসেন নামে হাসপাতালের এক ফার্মাসিস্টকে আটক করেছে র্যাব-৩।
গতকাল সোমবার (২৭ জুন) দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বহির্বিভাগের মেডিসিন স্টোরের সামনে থেকে তাকে আটক করা হয়। র্যাব-৩ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢামেক হাসপাতালে বহির্বিভাগের মেডিসিন স্টোরের সামনে থেকে বাইরে বিক্রির উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার সময় র্যাব তাকে আটক করে। এ সময় তার কাছ থেকে সরকারি বিক্রয় নিষিদ্ধ ১৯৫ ইনজেকশন (নেলবান) পাওয়া যায়। পরে তাকে পরিচালকের রুমে নিয়ে আসা হয়। পরিচালক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য র্যাবের হেফাজতের দিয়ে দেন। পরে তাকে হেফাজতে নেয় র্যাব। এ ঘটনায় বহির্বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার মো. আবুল বাসার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন শাহবাগ থানায়।
র্যাব আরও জানায়, আটক ইসমাইল হোসেন ঢামেক হাসপাতালে তৃতীয় শ্রেণি সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতির বর্তমান ক্রীড়া সম্পাদক। তার বাবার নাম আব্দুস কুদ্দুস মোল্লা। বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। এর আগেও সরকারি সুতাসহ ওয়ার্ড বয় হাকিমকে আটক করেছিল র্যাব।
সরকারি ইনজেকশনসহ র্যাবের হাতে আটক ইসমাইল হোসেন বলেন, আমি এই ইনজেকশন বাইরে নিয়ে ১৪ টাকা দামে বিক্রয় করি। এটা যে কোনো ফার্মেসি থেকে কিনতে গেলে ৯০ টাকা করে লাগে।
এ ঘটনার সঙ্গে আর কারা জড়িত? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেডিসিন স্টোরের প্রধান অনেকেই জড়িত আছে। তার মধ্যে অনন্ত, মনোয়ার হোসেন, সাইফুল ইসলাম তারাই বেশরি ভাগ লোকজন দিয়ে মালামাল বিক্রি করে। কিন্তু তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে। এ ছাড়া আরও অনেকেই এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, এটি একটি অপ্রীতিকর ঘটনা। আমাদের কর্মচারী যারা জড়িত আছে তাদের আমরা বারবার সতর্ক করে দিয়েছি। এটার মাধ্যমে অনেকেই সচেতন হয় এরপরেও অনেকে আছে তারা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেয় না।
তিনি বলেন, ‘র্যাব তাদের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সরকারি ওষুধ অন্যত্র সরিয়ে ফেলার সময় ইসমাইল হোসেন নামে এক ফার্মাসিস্টকে আটক করে। আমার বিশ্বাস সে সব অপকর্মের সঙ্গে লিপ্ত। যারা এই ঘটনার পরে সতর্ক হবেন না তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্হা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের সকলের প্রতি আপনাদের মাধ্যমে আমার মেসেজ থাকবে, এ সুযোগ কেউ যেন না নেয়। আপনাদের কাছে তথ্য থাকলে আমাদের জানাবেন আমরা এগুলো বন্ধ করতে চাই। আশা করি, আপনাদের সহযোগিতা পেলে এই অপকর্মগুলো আমরা বন্ধ করতে পারব।
অনেক ওষুধ আছে যেগুলো সহজে পাওয়া যায় না আমরা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিকে অনুরোধ করে জনগণের কথা চিন্তা করে এসব ওষুধ সংগ্রহ করি। একটি চক্র এ সব ওষুধ বাইরে বিক্রি করে দেয়। এর আগেও আব্দুল হাকিম নামে সরকারি একজন স্টাফকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সুতাসহ গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। সে জামিনে বের হয়ে এসে আবার একই কাজ শুরু করে দিয়েছে। এ সব সিন্ডিকেটরা বছরে পর বছর ধরে রোগীদের জীবন বাঁচার ওষুধসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বাইরে বিক্রি করে আসছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ওয়ার্ডবয় আব্দুল হাকিম বলেন, আমি সুতাসহ ধরা পড়ি। কিন্তু এসব সুতা গুলো আমাকে বিক্রির জন্য আই, সি,টির ইনর্চাজ অফিস সহকারী মনোয়ার হোসেন দেন। তার বিনিময়ে তিনি আমাকে কিছু টাকা দেন। এই মনোয়ার আমাকে, কর্মচারী আলামিন ও মুরাদকে দিয়ে সুতা, গ্লাপর্স ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বাইরে বিক্রির জন্য পাঠাতো। এক বার ইনর্চাজ মনোয়ার মিনি ট্রাক ভর্তি হাসপাতালের বরাদ্দকৃত গ্লাপর্স বাইরে বিক্রির সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কিছু দিন তাকে ইনর্চাজ থেকে সরিয়ে নেয়। পরে তাদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যায়। পরে তাকে আবার ইনচার্জ হিসেবে পূর্ণবহাল করে। মনোয়ার আইসিটির ইনচার্জ হয়ে আসার পর থেকে আবার পুরোদমে তার বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। তার জন্য ডেলিবেসিস কর্মচারী মুরাদের চাকরী চলে যায়।
হাকিম বলেন, ঠিকাদারের মাধ্যমে মালামাল ক্রয় করে। আবার তাদেরকে ম্যানেজ করে এই বেচাকেনা করে থাকে। এই মনোয়ার একই জায়গায় দীর্ঘ ১২ থেকে ১৫ বছর যাবত রয়েছে। তার নামে এত অভিযোগ থাকার পরেও কী কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে আইসিটি বিভাগ থেকে সরাচ্ছে এর রহস্য কী?
মেডিসিন ম্যান, স্টোরের প্রধানসহ এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা হাসপাতাল থেকে লাখ লাখ টাকার সরকারি ওষুধসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বাইরে পাচার করে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করছে। তাদেরকে জোরালোভাবে প্রতিরোধ না করা গেলে হাসপাতালে আগত রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এএইচ/এমএমএ/