নিউমার্কেটে সংঘর্ষ: সুষ্ঠু বিচার চায় নিহত নাহিদের পরিবার
নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী-কর্মচারী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় মারা যান ২০ বছর বয়সী নাহিদ হোসেন। নাহিদের পরিবার বলছে, তার রোজগার দিয়ে চলত পাঁচজনের সংসার। পরিবারটির কাছে শোকের পাশাপাশি এখন বড় প্রশ্ন, সংসার চলবে কীভাবে। এমন চিন্তার পাশাপাশি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চান তারা।
এদিকে নিউমার্কেট সংঘর্ষের ঘটনায় থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে দুটি মামলার বাদী পুলিশ এবং একটি মামলার বাদী নিহত নাহিদের চাচা মো. সাইদ, আর একটি মামলার বাদি নিহত মোরসালিনের ভাই নুর মোহাম্মদ।
শুক্রবার (২২ এপ্রিল) পুলিশ ও নাহিদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে। নাহিদের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, নিহত নাহিদের পরিবার তার হত্যার বিষয়ে সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে থানায় একটি মামলা করেছেন।
দোকানমালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষের ঘটনায় মারা যাওয়া নাহিদ ডি-লিংক নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ‘ডেলিভারিম্যান’ হিসেবে কাজ করতেন। তার বাসা রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের রনি মার্কেটের মেম্বার গলিতে। আধা কাঠা জমির উপর নাহিদদের বাড়ির কাঠামোটি। চিকন সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলার ঘর। সেই ঘরে থাকেন বাবা নাদিম হোসেন, মা নার্গিস এবং ছোট দুই ভাই শরীফ ও ইব্রাহিম। আর তৃতীয় তলায় টিনশেডের ঘরে থাকতেন নাহিদ হোসেন ও তার স্ত্রী ডালিয়া। ধীরে ধীরে বাড়ি-সংসার সাজানোর কথা ছিল নাহিদের। কিন্তু অবশেষে তিনি চিরতরে হারিয়ে গেল।
জানা যায়, ঘটনার দিন নাহিদ সকাল ১০ টায় কর্মস্থলের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। দুপুরে নিউমার্কেট এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মাথায় আঘাত পেলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ওই দিন রাতে তার মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাহিদের ১৮ বছর বয়সী স্ত্রী ডালিয়া বলেন, নাহিদ খুব ভালো মানুষ ছিল। আমরা নাহিদ হত্যার বিচার চাই। ‘নিজের জন্য নাহিদ কিছু কিনতে চাইত না। একটা শার্ট, প্যান্ট, জুতা কিনত না। খালি আমাদের জন্য কেনাকাটা করত। আমার কোনটা লাগবে, কোনটা প্রয়োজন, সব আমাকে নিয়েই করত। এখন আমাকে কে দেখবে, আমাকে কে ভরসা দেবে। এবার ঈদে আমরা নাহিদকে ছাড়া কিভাবে থাকব?
নাহিদের বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় চোখে পড়ল ডালিয়ার দুই হাতভরা রাঙা মেহেদির নকশা। বাঁ হাতের তালুতে মেহেদি রঙে ইংরেজিতে লেখা, ‘আই লাভ ইউ নাহিদ।’ নাহিদের স্ত্রী সেদিকে লক্ষ রেখে বলেন, ‘নাহিদ চলে গেল কিন্তু রেখে গেল ভালোবাসার স্মৃতি।
এদিকে নাহিদের মা নার্গিস বেগম বলেন, আমার তরতাজা পোলাডা কেমনে চলে গেল, এটা কেমন কথা? ছেলে হারিয়ে শোকাহত নাহিদের মা।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনার আমরা বিচার চাই। নাহিদকে তো আর ফেরত পাব না। তারপর ও বিচার চাই। দোষীদের বিচার হলে আমরা শান্তি পাব। আর যানি কারো মায়ের বুক এভাবে খালি না হয়।
তিনি বলেন, এবার নাহিদ ছাড়া ঈদ আমাদের কেমনে হবে? নাহিদ নাই আমাদের ঘর-সংসার চালাবে কে? তারপরও আমরা বিচার চাই।
তিনি বলেন, ‘মামলা চালাতে টাকাপয়সা লাগে। খরচও হয়। এরপরও নাহিদের চাচা বাদি হয়ে একটি মামলা করেছেন। তিনি বলেন, ওই মামলায় আমরা আসামিদের শাস্তির দাবি জানাই।
জানা যায়, নাহিদরা তিন ভাই। নাহিদ সবার বড়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন নাহিদ। এরপর আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে লেখাপড়া আর এগোয়নি। পরিবারের হাল ধরতে অল্প বয়সেই কাজে নেমে পড়েন নাহিদ। সাত হাজার টাকা বেতনে গত দুই বছর কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন।
পরিবার বলছে, বেতনের পুরো টাকাই সংসারে দিতেন নাহিদ। নিজে থেকেই ছেলের কথা বলছিলেন আর ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। নাহিদের মা বলেন, ‘নাহিদের বাবা একটা কোম্পানিতে কাজ করে অল্প কিছু টাকা পায়। এটা দিয়ে ঋণ শোধ করতে হয়। আর সংসার চালাত আমার ছেলে নাহিদ।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাহিদের চাচা মো. সাইদ বলেন, আমরা নাহিদ হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার চাই এবং ক্ষতিপূরণ চাই। তিনি বলেন, নাহিদ ছাড়া ওই পরিবারের আয় রোজগারের কেউ নেই।
জানতে চাইলে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইয়ামিন কবীর বলেন, নাহিদ হত্যাকাণ্ডে ১৫০-২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করা হয়েছে। এবং ৩০২/৩৪ ধারায় মামলাটি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রথমিকভাবে কিছু আলামত পেয়েছি, সেগুলি নিয়ে কাজ চলছে এবং মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষে এই মামলার সার্বিক বিষয়ে বিস্তারিত জানানো যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স ম কাইয়ুম বলেন, রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে দোকান কর্মচারী মোরসালিনের মৃত্যুর ঘটনায় আরও একটি হত্যা মামলা করেন তার ভাই নুর মোহাম্মদ। মোট ৪টি মামলার তদন্ত চলছে।
কেএম/আরএ/