রাজধানীজুড়ে অসহনীয় যানজট, নিশ্চুপ সেবা সংস্থা
সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনীহার কারণেই রাজধানীতে বাড়ছে যানজট। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে রাজধানী ঢাকা আরও নিশ্চল হয়ে যাবে বলেও মনে করেন তারা। রাজধানীজুড়ে অসহনীয় যানজট হলেও সেবা সংস্থাগুলো নিশ্চুপ।
ঢাকাকে নিয়ে কাজ করে ৭টি মন্ত্রণালয় ও ৫৪টি প্রতিষ্ঠান। এসব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করছে। সবগুলো প্রকল্পের উদ্দেশ্য দেখানো হয় ঢাকাকে সচল করতে বাসযোগ্য করতে; কিন্তু বাস্তবায়ন শেষে সেসব প্রকল্পের সুফল নগরবাসী কতটুকু পেল তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। শহরের ভেতরে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও তার সুফল মানুষ পাচ্ছে না বলে জানান তারা। তাই অচিরেই সমন্বিত ব্যবস্থাপনা চালু করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে–একটি আদর্শ সিটিতে সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সড়ক এলাকার বরাদ্দকৃত ভূমি ২০ থেকে ২৫ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষকরা। সেই ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকায় ১০ ভাগেরও কম সড়ক বিদ্যমান। তা সত্ত্বেও সেবাসংস্থা, সড়ক সংস্থা ও নগর সংস্থাসমূহের সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ি, অনিয়ন্ত্রিত পার্কিং ও হকার অব্যবস্থাপনার কারণে ঢাকার সড়কগুলো সক্ষমতার ৬০-৭০ ভাগের বেশি কার্যকারিতা দেখাতে পারে না। আবার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নগর এলাকার জনঘনত্ব ৬০ থেকে ৮০ জন প্রতি একরে, যা অল্প কিছু আরবান ডিস্ট্রিক্টে সর্বোচ্চ ১২০ হতে পারে; কিন্তু ঢাকায় জনঘনত্ব একর প্রতি ৩০০-৪০০ জন, কোনো কোনো এলাকায় ৬০০-৭০০ লোকও বাস করে প্রতি একরে। ফলশ্রুতিতে ঢাকার সড়কগুলো তার কার্যকর সক্ষমতার ৬-৭ গুণ ট্রাফিক ধারণ করার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
অন্যদিকে প্রতিদিনই সড়কে নামছে নতুন নতুন গাড়ি। আর রাজধানীকে ঘিরে বিভিন্ন সেবা সংস্থার অনিয়ন্ত্রিত খোঁড়াখুঁড়ি লেগেই থাকে বছরজুড়ে। ফলে দিন দিন নিশ্চল হয়ে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা। এ অবস্থা থেকে বের হতে সরকারের সদিচ্ছা ও কঠোর সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
যানজটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের যে উন্নয়ন কর্ম পরিকল্পনা তাতে মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের মাথাপিছু আয় যখন বাড়েবে তখন গাড়ীর সংখ্যাও বাড়বে। ফলে যানজট আগামীতে আরও বাড়বে।’
রাজধানী ঢাকাকে নিয়ে ৭ টি মন্ত্রণালয় ও ৫৪টি প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও। যানজট নিরসনে আলাদা করে কারও কোনো পরিকল্পনা নাই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সড়কের সংস্কার ও উন্নয়ন করলেও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ব্যর্থ। তাদের এই ব্যর্থতায় যানজট আরও অসহনীয় হয়ে উঠছে। ফুটপাত দখলমুক্ত বর্জ্য মুক্ত ঢাকা শহর গড়তে না পারলেও ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে চায় সিটি করপোরেশন।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘সিটি করপোরেশনগুলোর উপর যেসকল দায়িত্ব ন্যাস্ত রয়েছে সেগুলো পরিপূর্ণ করতে পারলেই তখন এটা নিয়ে ভাবা যাবে। আগে তাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে।’
রাজধানী ঢাকার যানজটের সমাধান তুলে ধরে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘যানজট নিরসনের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিন্টু রোডে সচিবদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট করে দিয়েছেন। শুধু প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলেই হবে না এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। মিন্টু রোডে সচিবদের অ্যাপার্টমেন্ট করার অন্যতম কারণ সচিবরা এখান থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে অফিসে যেতে পারবেন। এখন সচিবদের জন্য যদি দুটি অত্যাধুনিক বাস বা চারটি উন্নতমানের মাইক্রোবাস দেওয়া যায় তাহলে পরদিনই যানজট কমে যাবে। এই ব্যবস্থা চালু করলে ১১৪টি প্রাইভেট কার রাস্তায় থাকবে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগত গাড়ীকে রাস্তায় নিরুসাহিত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা শহরকে নিয়ে ৭টি মন্ত্রণালয়ের ৫৪টি প্রতিষ্ঠান কাজ করে। এসব প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয় ঢাকা শহরের জনগণের সেবা করতে যেয়ে ভোগান্তিতে শেষ করে ফেলেছে। এজন্য সেবা সংস্থাগুলোকে একই ছাতার নিচে এনে জনপ্রতিনিধিদের অধিনস্ত করতে হবে। জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এখনই ব্যক্তিগত গাড়ির লাগাম টেনে ধরতে হবে। একটি শহরে কতটি গাড়ী নামতে পারে তার একটা পরিসংখ্যান থাকা দরকার। ছোট ছোট গাড়িকে নিরুসাহিত করে গণপরিবহনের দিকে নজর দিতে হবে।’
ঢাকায় যানজট বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে দীর্ঘ দিন ধরেই যানজট হচ্ছে। নতুন করে আরও বেশি যানজট হওয়ার কারণ করোনায় কিছু মানুষ গাড়ি কিনেছে। আর কিছু মানুষ যারা বেকার হয়েছে। যে কারণে হঠাৎ শহরে রিকশা ও মটরসাইকেল বেড়ে গেছে। এমনিতেই যানজট ছিল এখন আরও বেড়েছে।’
এসএম/এসএ/