শাবিপ্রবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে অধ্যাপক, ছাত্র-ছাত্রী খুব কম
লেখা ও ছবি : নুরুল ইসলাম রুদ্র, শাবিপ্রবি
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রথম বিজ্ঞান-প্রযুক্তি শিক্ষার উচ্চতর বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসের গোলচত্বর ও ডি-বিল্ডিংয়ের মাঝে সুসজ্জিত, চোখ জুড়ানো এই চারতলা ভবন। ১৯৯০ সালে মোটে চারটি ঘরে, সামান্য বই নিয়ে অ্যাকাডেমিক ভবন ‘এ’তে চালু হয়েছে গ্রন্থাগারটি। এখন নিজেদের ভবনটি আছে। তার তৃতীয় ও চতুর্থ তলা জুড়ে লাইব্রেরি কার্যক্রম চলছে।
অনলাইনে আছে, মোট ৭৫ হাজার বই আছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। ছয় হাজার কপি জার্নাল ও সাময়িকী রয়েছে। প্রতিদিন ২৩টি সংবাদপত্র ব্যবহারকারীদের জন্য রাখা হয়। অনলাইন সেবা আছে গ্রন্থাগারটির। ২৫ হাজারের বেশি ই-জার্নাল ও ই-বুক এবং ই-গবেষণাপত্র আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে চুক্তিতে তাদের ই-লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারেন তারা। ইউজিসি ডিজিটাল লাইব্রেরির ৩৭ হাজার ৫শ ই-বইগুলো ব্যবহার করতে পারেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব আইপিএস ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সেবাগুলো প্রদান করে। বিরাট এই গ্রন্থাগারের জন্য মোট আছেন ৩৮ জন অফিসার ও কর্মচার্রীর বিরাট দল। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কম্পিউটারাইজ সার্ভিস সেবা চালু করেছেন। এই গ্রন্থাগারের ই-লিংক হলো http://library.sust.edu. তাদের সিসিটিভি ব্যবস্থায় চালু থাকে সর্বক্ষণ। মোট ৩২টি ক্যামেরা আছে। মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার রয়েছে। তাতে মুক্তিযুদ্ধের বই, পোস্টারগুলো, মানচিত্রগুলো, ভিডিও, প্রমাণাদি আছে। ২০ হাজারের বেশি বই আছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে মোট নয় হাজার ছাত্র, ছাত্রী পড়ালেখা করেন। তাদের জন্য হাজারের বেশি অধ্যাপক আছেন। সবার বই পড়ার সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি। তাদের জন্য ১শর বেশি আসন আছে। পড়ালেখা ও গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য শুক্র এবং শনিবার ছুটির দিন বাদে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মদিবসে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সর্বক্ষণ সেবা প্রদান করা হয়। ছাত্র, ছাত্রীরা গ্রন্থাগার সেবার সময় বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করেছেন। ফলে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে আটটার সময় বেড়ে হয়েছে রাত ১০টা। এই লেখাটির জন্য একটি সপ্তাহ টানা গ্রন্থাগার ভবন পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, বেশিরভাগ দিন রাত ৮টার পর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ছাত্র, ছাত্রীরা থাকেন না। কোনো, কোনোদিন মোটে ৪ থেকে ৫ জন ছাত্র, ছাত্রী পড়ালেখা করছেন। প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জনের বেশি ছাত্র, ছাত্রী এই গ্রন্থাগার ব্যবহার করছেন না। দিনে এই প্রতিবেদকের উপস্থিতির সময় বেশিরভাগ ছাত্র, ছাত্রীর সামনে বই নেই। তারা পড়ালেখা করছেন না। অধ্যাপকদের দেওয়া ক্লাস শিট, নোট ও স্লাইড নিয়ে ক্লাসের পড়াই পড়ছেন। অনেকে মোবাইলে ব্যস্ত, ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছেন। বই পড়ছেন না কেন-এই প্রশ্নের জবাবে ছাত্র, ছাত্রীরা বলেছেন, আমাদের কোনো কোর্স কোনো নিদিষ্ট বই ধরে পড়ানো হয় না। অধ্যাপকরা একাধিক পাঠ্য বই মিলিয়ে পড়ান ও সেগুলো কিনে পড়তে পরামর্শ দেন। লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করতে বলেন। তবে এই বিদেশী বইগুলোর অনেক দাম বলে কেনার সামর্থ্য বেশিরভাগেরই হয় না। আপডেট এই বইগুলো কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিও কোর্স এবং বিষয় ধরে রাখে না। ফলে কোনো বই কেনা হয় না। অধ্যাপকদের দেওয়া ক্লাস শিট ও তৈরি নোটই ভরসা থাকে। এজন্য সেগুলো এখানে পড়ালেখার জন্য নিয়ে আসেন তারা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রীদের আরেকটি অভিযোগ হলো, বই ও খাতা-কলম বাদে ব্যক্তিগত আর কোনোকিছু গ্রন্থাগারে নিয়ে আসতে দেওয়া হয় না। তাতে তারা আর কিছু দরকার হলেও আনতে পারেন না। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসহ তাদের সব বিভাগের গ্রন্থাগারেই এই ব্যবস্থা চালু আছে।
গ্রন্থাগার ব্যবহার করা ছাত্র, ছাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, আমাদের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বেশিরভাগ বই হলো ইংরেজি ভাষার। বইগুলো পুরোনো। আমাদের ইংরেজি মাতৃভাষা নয় ও বইগুলো হাল আমলের নয় বলে পড়তে কষ্ট হয়। তারা জানিয়েছেন, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের টানা ২৫ বছরের কর্মস্থল এই গ্রন্থাগারে বাংলা ভাষার বই খুব আছে। যেগুলো রয়েছে, বেশিরভাগ সময় খুঁজে এনে দিতে পারেন না লাইব্রেরির স্টাফরা। তাতে পড়ার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না তাদের পক্ষে। এই আলাপে বিশ্ববিদ্যালয়টির সমাজকমের ছাত্র রুবিয়ান শান বলেছেন, ‘অনেক খুঁজেও আমাকে পড়ার মতো কোনো মানসম্পন্ন বাংলা বই একবার তারা এনে দিতে পারেননি। ফলে গ্রন্থাগারে আসতে ভালো লাগে না।’ তিনি জানিয়েছেন, ‘সময়ের হাত ধরে ভালো মানের ইংরেজি ও বাংলা বইগুলো থাকলে আমাদের আসতে ইচ্ছে করবে, গ্রন্থাগারে পড়তে ভালো লাগবে।’ চাহিদার বইয়ের অভাব এবং বাইরের ভালো বই না নেবার নিয়মেও তাদের অনেকে গ্রন্থাগারে আসতে চান না।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব ভালো একটি নিয়ম হলো-এখানে চাকরির গাইড বা এমন কোনো বই নিয়ে আসা যায় না। সেখানে অ্যাকাডেমিক বইও নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কেবল ক্লাস নোট গ্রন্থাগারে বসে কেন পড়ছেন-এই প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্র হাসিবুল কবীর শিমুল বলেছেন, ‘আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন না, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে গভীর জ্ঞানের চেয়ে পরীক্ষার ফলাফলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের সবখানে। আমরা জানি, ক্লাসে শিক্ষকদের দেওয়া লেকচারের নোট নিয়ে, অ্যাসাইনমেন্ট করে মোটামুটি ভালো ফলাফল করা সম্ভব হয়। তাই জ্ঞানের খোঁজে বই না পড়ে অল্পতে ভালো ফল করতে, সময় কম দিয়ে শিট পড়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছি সবাই।’ তবে এই ছাত্রটি জানালেন, ‘ভালো মানের গবেষক হতে হলে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। বলেছেন, ‘যারা বিদেশে গবেষণায় যেতে চান, তাদের অনেকে বই পড়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সেভাবে ক্যারিয়ার গড়েন।’
কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সবচেয়ে বড় সুবিধাটির কথা জানালেন সমাজকমের ছাত্রী সানজিদা নওরিন সুবর্ণা, ‘আমাদের গ্রন্থাগারটি বাদে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভবনের কোথাও রিডিং রুম নেই। তবে এখানে কোর্সের, প্রচলিত ও আমাদের উপযোগী আধুনিক বইগুলো না থাকায় আমরা কেউ ভালোভাবে পড়ালেখা করতে পারি না।’
ছাত্র, ছাত্রীদের এই সমস্যাগুলোর সমাধান এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার নিয়ে বলতে গিয়ে প্রশাসক ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুল বাতেন ঢাকা প্রকাশের বিশ্ববিদ্যালয়র প্রতিনিধি ও তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল ইসলাম রুদ্রকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেন্দ্রীয় নীতিমালা হলো-কোনো ছাত্র, ছাত্রী, অধ্যাপক সঙ্গে করে কোনো বই নিয়ে গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতে পারবেন না। সাধারণ কিছু সমস্যা হয় বলে আগে থেকে নিয়মটি চালু আছে। কেন্দ্রীয়ভাবে পরিবর্তন করা না হলে প্রশাসক হিসেবে আমার পক্ষে সিদ্ধান্তটি পরিবতন করা সম্ভব নয়।’
অধ্যাপক ড. আজিজুল বাতেন ছাত্র, ছাত্রীদের চাহিদানুসারে বই অপ্রাপ্তির বিষয়ে বলেছেন, ‘প্রতি বছর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যেসব বই অর্ন্তভুক্ত করা হয়, সেগুলো বিভাগগুলোর মাধ্যমে আসে। গ্রন্থাগারের নিয়মে, প্রতিটি বিভাগকে তাদের ছাত্র, ছাত্রী ও শিক্ষকদের প্রতি বছরের চাহিদার বইগুলোর তালিকা দিতে অনুরোধ করা হয়। তাদের সেই বইগুলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে সবার জন্য কিনে রাখি। ফলে শিক্ষার্থীদের চাহিদাগুলো তাদের বিভাগগুলোতে বলতে হবে।’
ওএস।