পরিবারের শূন্যতা পূরণ করে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ইফতার
প্রতিদিন পড়ন্ত বিকেলে সূর্যটা যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে। যখন ক্যাম্পাসের চারপাশে সবুজ গাছপালাগুলোর ছায়ায় মাঠ আচ্ছাদিত হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই নিরুত্তাপ রোদ মনে করিয়ে দেয় সন্ধ্যা নামতে আর দেরি নেই। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) কেন্দ্রীয় মাঠ, আবাসিক হলগুলোর মাঠ ও শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শুরু হয় রোজাদারের ইফতারের আয়াজনে।
এই তো কয়েক দিন আগেও মাঠে আনাগোনা ছিল ব্যাট আর বল হাতে। রমজান আসতেই সেখানে আজ ভিন্ন চিত্র। সেই সবুজ ঘাসের বুক চিরে শীতল পাটি কিংবা পত্রিকার ছেড়া অংশ বিছিয়ে সবাই বসে ইফতার নিয়ে।
সবার সামনে সাজানো আছে বাহারি রকমের ইফতার সামগ্রী। শরবত, ছোলা, পেঁয়াজু, আলুর চপ, ঘুগনি, বেগুনি, কলা, শশা, বরিন্দ্রা, খেজুর, জিলাপিসহ নানা ধরনের ফল আর কত কী!
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রাণের ভূমিতে অবস্থিত এবং তার নামেই প্রতিষ্ঠিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষার্থীরা সারাদিনের পড়ালেখার চাপের ফাঁকে সবাই ছুটে আসে এই প্রানবন্ত আমেজের খোঁজে। আর তখন ইফতারির মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয় পরিবারের শূন্যতাটুকু। কেউ কারো প্লেটে ছোলা দেয়, তো কেউ কারো প্লেটে আলুর চপ বা ফল দেয়। আবার কেউ কেউ গলা ভিজানোর জন্য দেয় বাহারি রকমের শরবত।
শত ব্যস্ততার পরও পরিবার ছেড়ে এই চৈত্রের খরতপ্ত দিন শেষে সবাই এই বন্ধনের মধ্যে যেন খুঁজে ফেরে একটুকরা প্রশান্তি। ৭৫ একরের এই ছোট্ট মরুর বুক চিরে এ যেন এক সবুজ গালিচা। মাঠের কোথাও সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজন, কোথাও রাজনৈতিক দলের, কোথাও বা সামাজিক সংগঠনের আয়োজন অথবা অল্প কিছু কাছের বন্ধুবান্ধদের ইফতারের আয়োজন। আবার কোথাও জেলা কিংবা বিভাগভিত্তিক ছাত্র সংগঠনের আয়োজন।
এ ছাড়াও দেখা মেলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের। তারা সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের সঙ্গে এক হয়ে করছে ইফতারের আয়োজন। এভাবেই শিক্ষার্থীরা ইফতারের মধ্যে খুঁজে ফিরছে তৃপ্তির ছোঁয়া। এই প্রিয়জনগুলো যেন তাদের দ্বিতীয় পরিবার।
অন্য ধর্মাবলম্বীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেও ক্যাম্পাসের ইফতার হয়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িকতার এক অনন্য উপমা। বন্ধুদের সঙ্গে বসে ইফতার করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনের বিভাগের শিক্ষার্থী তমাল চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসের ইফতার এ যেন এক ভিন্ন প্রশান্তি।
এ প্রসঙ্গে জেন্ডার অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট স্টাডিস বিভাগের ১১ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শামীম আহমেদ বলেন, 'সত্যিই অনেক ভালো লাগা কাজ করে। সিনিয়র-জুনিয়র সবাই একসঙ্গে এক জায়গায় বসে ইফতারি করা। আর এই সবকিছু আমাদের যেমন ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে তেমনি উপভোগও করেছি।'
মার্কেটিং বিভাগের ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আল-আমিন বলেন, 'সবাই পরিবার ছেড়ে বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান মিলেমিশে একসঙ্গে সবাই ইফতারে অংশগ্রহণ করছি। ইফতারের আগে আমাদের সেন্ট্রাল মাঠের দিকে যখন তাকাই হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। দলবদ্ধভাবে বসে যখন ইফতার করি, মনে হয় নতুন পরিবার পেয়েছি। পরিবার ছেড়ে আসার কষ্টটা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।'
রসায়ন বিভাগের ১২ ব্যাচের শিক্ষার্থী তাসকিয়া তাবাসসুম বলেন, 'এ যেন এক মিলনমেলা, প্রিয় বন্ধুদের এক রমজানের ইফতার করা একসঙ্গে বসে। খোলা আকাশের নিচে বসে ইফতার, বিষয়টি সুন্দর। এখানে কোনো ভেদাভেদ, শ্রেণি বৈষম্য নেই। সন্ধ্যেটা যেন আরও সুন্দর হয়ে যায় এই দৃশ্য দেখে। পরিবার ছেড়ে এসে রুমে একা বসে ইফতার করার চেয়ে সবাই মিলে ইফতার করার আনন্দ বেশি। পরিবারের শূন্যতা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যাই আমরা। মনে হয় আমরা একা নই। এরকম সুন্দর দৃশ্য কালের সাক্ষী হয়ে থাকুক।'
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গাজী আজম বলে, 'পবিত্র মাহে রমজানের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সম্প্রীতি প্রয়োজন। সকল শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, জাতি বিভেদ ভুলে গিয়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে ইফতারে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে প্রাণের বেরোবি ক্যাম্পাস। এই দেখে পরিবারের অপূর্ণ তা পূর্ণতা পায় এই ক্যাম্পাসের ইফতারের মাধ্যমে।'
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নয়, এই আমেজ থেকে বঞ্চিত হতে চান না ঘুরতে আসা সাবেক শিক্ষার্থী এবং আশপাশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। সারা দিনের রোজার ক্লান্তি ভুলে পরিবারের মানুষের শূন্যতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন দ্বিতীয় পরিবারের সঙ্গ নিয়ে।
এসএন