৫৩ বছরে পা রাখল জাবি, ছোট নয় অপ্রাপ্তির তালিকা!
প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর গৌরবগাথার স্মৃতি নিয়ে বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ২০২৩ উৎসব পালিত হচ্ছে। অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশ নেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নানা স্মৃতিচারণের সঙ্গে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিবাচক পরিবর্তন কামনা করেছেন। তাদের আশা, শুধু ভৌত কাঠামো নয় শিক্ষা ও গবেষণার মানেরও উন্নতি হবে। জায়গা করে নেবে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাতারে।
প্রতিষ্ঠার ৫২ বছর শেষে ৫৩ বছরে পা রেখেছে দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক চরিত্র নিয়ে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়টি। রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পশ্চিম পাশ ঘেঁষেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ১৯৬৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ৭৫০ একর জমি বরাদ্দ থাকলেও আশির দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে ৫০ একর ছেড়ে দেওয়ার ফলে বর্তমানে এর পরিমান দাঁড়ায় ৬৯৭.৫৬ একর।
ঢাকা শহরের মুঘল আমলের নাম 'জাহাঙ্গীরনগর' থেকেই ১৯৭০ সালে 'জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে মুসলিম শব্দটি কেঁটে এর নাম রাখা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি স্নাতক পর্যায়ে প্রথম ক্লাস শুরু হলেও ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রিয়ার এডমিরাল এস.এম আহসান।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রথমে মাত্র ৪টি বিভাগ ২১ জন শিক্ষক আর ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের পরিবর্তনে এখন ৬টি অনুষদের অধীনে ৩৬টি বিভাগ ও চারটি ইন্সটিটিউটে সাত'শ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর বসবাস। নানা প্রাপ্তির মাঝেও হিসাবের খাতায় ছোট নয় অপ্রাপ্তির তালিকাও। দীর্ঘ এ পথচলায় নানামুখী সংকট ছিল প্রতিষ্ঠানটির নিত্য সঙ্গী। তাই ৫৩ বছরেও দুর্নীতি, অনিয়ম ও আবাসন সংকট সহ নানামুখী সংকট ঘিরে আছে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে।
আবাসন সংকট:
বিশ্ববিদ্যালয়টি পূর্ণ আবাসিকতার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠার পাঁচ দশক পেরিয়ে এখনো নিশ্চিত হয়নি শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা। ছেলে এবং মেয়েদের ৮ টি করে মোট ১৬ টি হল থাকা স্বত্বেও তৃতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থীকেও থাকতে হচ্ছে গণরুমে। তীব্র সিট সংকটে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যঘাত ঘটছে বলেও দাবি জানান অনেকে।
৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল হাই স্বপন জানান, 'আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরও এখানে তৃতীয় বর্ষের একটা শিক্ষার্থীকে থাকতে হয় গণরুমে। রিডিং রুমের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব। ডাইনিং এবং ক্যান্টিনের খাবারের মানের অবস্থা যাচ্ছেতা।দেখার বোধহয় কেউ নাই'।
শিক্ষার মান এবং সেশন জট:
প্রায় পাঁচ দশকের অধিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ, বিভাগ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার মান নিশ্চিত হয়নি। শিক্ষার অন্যতম অংশ গবেষণায়ও নেই উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শিক্ষা-গবেষণায় মন না দিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন অভ্যান্তরীন রাজনীতিতে। ফলে একরকম গবেষণা খরার মধ্যদিয়েই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। একইসাথে বিভিন্ন বিভাগ এখনো সেশনজট নামক অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
একাধিক ১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায় , করোনাকালীন সময়ের এক বছর বাদ দিলেও, এখন তৃতীয় বর্ষে থাকার কথা তাঁদের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ এবং দর্শন বিভাগের এখনো ২য় বর্ষেরই ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন হয়নি। কবে নাগাদ পরীক্ষা হবে তার নেই ঠিক। এরকম অনেক গুলো বিভাগেই রয়েছে তীব্র সেশন জট।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন:
৫৩ বছরে এসেও শুনতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের যে পরিকল্পনা সেখানে রয়েছে ঘাটতি। যে-মন ইচ্ছে তেমন সাজো এর মতোই চলছে এখানকার উন্নয়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি প্রশাসনিক ভবন থাকা স্বত্তেও তৈরি করা হচ্ছে নতুন আরেকটি প্রশাসনিক ভবন। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ২৫ বছর মেয়াদ থাকা স্বত্তেও নতুন আরেকটি গ্রন্থাগার তৈরি হচ্ছে। পুরাতন গ্রন্থাগার ভেঙে ফেলার পায়তারা চলছে।
থাকার মতো আগ্রহী কাউকে না পাওয়ায় ১৯০টি বাসাই খালি পড়ে আছে। তবুও ১২০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হচ্ছে শিক্ষক কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের জন্য নতুন ভবন। নির্বিগ্নে গাছ কাটা নিয়ে প্রশাসনকে প্রশ্ন করা হলে বলা হচ্ছে, এটাতো বনভূমি নয়, গাছ কাটতে কিসের বাঁধা।
অপরিকল্পিত এবং খামখেয়ালি উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমর্ত্য রয় বলেন, 'আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করার কথা। মাস্টারপ্ল্যান থাকলে ঢেকসই উন্নয়ন হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওইদিকে মনোযোগী না। খামখেয়ালি উন্নয়নে মজেছেন উনারা'।
ছাত্ররাজনীতিতে পরেছে মরীচিকা:
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন সর্বশেষ হয়েছিলো ১৯৯০ সালে। প্রায় তিন যুগ পেরিয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা নির্বাচনের দাবি করে এলেও এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। প্রশাসন, শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতিসহ সব জায়গায় বিস্তার করে আছে ক্ষমতাশীনদের প্রভাব। ক্যাম্পাসে নিশ্চিত হয়নি সব রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থানও। ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়ার কারনে মেধাবীরা ছাত্র রাজনীতিতে আসতে চাচ্ছে না বলেও দাবি করেন অনেকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, ছাত্র সংসদ প্রতিটি শিক্ষার্থীদের দাবির জায়গা। জাকসু হচ্ছে শিক্ষার্থীদের দাবি তুলার বড় জায়গা। এতো বড় প্লাটফর্ম থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বার বার বঞ্চিত হচ্ছে। নতুন নেতৃত্ব বিকশিত করার জন্য হলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাই।
ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক অর্মত্য রয় বলেন, জাকসু নেই ৯০ সাল থেকেই। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অলিখিত চুক্তি হয় জাকসু নির্বাচন যাতে না হওয়ার জন্য। জাকসু নেই বলেই গণরুম সংস্কৃতি, র্যাগিং কালচার, পাওয়ার প্রাকটিস রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে উপাচার্য ড.নূরুল আলম বলেন, 'বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অতীত ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় আরও বেশি মনোনিবেশ করবো'।
এএজেড