নারী শিক্ষার্থীদের ভাবনায় বেগম রোকেয়া
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা একটা সময় অপসংস্কৃতির আর নারীবিদ্বেষী নিয়মের বেড়াজালে বন্দি ছিলো। সেসময় ইংরেজি শিক্ষা তো দূরের কথা মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণই ছিল নিষেধ। মেয়েদের কাজ ছিল সন্তান জন্মদান, লালনপালন ও গৃহ কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি নিজ পরিবারেও মতামত প্রকাশ করা ছিল কঠিন কাজ।
বাইরের জগতে বের হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। ঠিক সেই সময় ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। নারীদের পড়াশোনা প্রচলন না থাকায় তাকে ঘরেই আরবি ও উর্দু শিক্ষা নিতে হয়। তবে জ্ঞানের নেশা যাকে পেয়ে বসে তাকে থামানো যায় না। বেগম রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম ছিলেন আধুনিকমনস্ক। তিনি বেগম রোকেয়াকে বাংলা ও ইংরেজি শেখান। তবে তা পরিবারের অন্য সদস্যদের অন্তরালে।
নিজ পরিবারে একাধারে ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী থাকলেও বড় ভাইয়ের মতো আধুনিকমনস্ক মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন রোকেয়া। যা পরবর্তীকালে তার জ্ঞান তৃষ্ণাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার জন্য এমন ধ্যান ছিল বলে তিনি হতে পেরেছেন নারী জাগরণের অগ্রদূত।
তার হাত ধরে, নারীরা অধিকার আদায়ে পরবর্তীতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তবে শুধু নারী জাগরণের অগ্রদূত বললে বেগম রোকেয়ার ভূমিকাকে সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না। কারণ যে পরিবেশের মধ্যে থেকে তিনি ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে সাহিত্য রচনা করেছেন, তাও বিবেচনায় আনতে হবে।
আবার পুরুষ জাতিকে চোখে আঙুল দিয়ে নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার কাজটিও ভালোভাবে করেছিলেন তিনি। বেগম রোকেয়ার সাহিত্য সাধনা প্রসারিত হয় বা সামনে আসার সুযোগ করার পিছনে যে ব্যক্তির ভূমিকা রয়েছে তিনি বেগম রোকেয়ার স্বামী ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন।
বর্তমানে নারী শিক্ষার্থীরা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবদানকে মনে প্রাণে স্বীকার করে। কারণ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে যার ফলে নারীরা আজকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে। তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন এবং নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায় তার পথ দেখিয়েছেন। তাকে নিয়ে বর্তমান নারী শিক্ষার্থীরা তার অবদানের কথা ব্যক্ত করে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মল্লিকা রাণী রায় বলেন, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু কবেছিলেন। সেজন্য আমরা আজকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতেছি। নয়তো আজকে একবিংশ শতকে আমরা নারীরা সমাজের নিয়ম-শৃঙ্খলায় বাঁধা থাকতাম।
তিনি আরও বলেন, পরিবার যদি পাশে থাকে মেয়েরা বিশ্ব জয় করতে পারবে। রোকেয়া যেমন পাশে পেয়েছে তার বড় ভাইকে এবং পরবর্তীতে তার স্বামীকে। বেগম রোকেয়ার অসামান্য অবদানের কারণে মেয়েরা যে তাদের নিগৃহের পরিবেশ থেকে বের হতে পেরেছে এটাই তার বড় অবদান। কয় জন পেরেছে এমন অবদান রাখতে?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী রূপা কর্মকর বলেন, বাংলা সাহিত্যের নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং নারী শিক্ষা প্রসারের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি তার সাহিত্য কর্মে তৎকালীন নারী সমাজের করুন দশা ও তা থেকে নারী মুক্তির পথ প্ৰদৰ্শন করেছেন। তার লেখা জাগো গো ভগিনী, মতিচূর, অবরোধ বাসিনী লেখায় অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন এবং নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায় তা নিয়ে কাজ করে গেছেন।
আকিজ কলেজ অব হোম ইকোনমিক্সের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের সাদিয়া জাহান সারা বলেন, বাংলার ইতিহাসে নারী অধিকার ও নারী শিক্ষার কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমাদের মাথায় যে মহীয়সী নারীর কথা মাথায় আসে তিনি হলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন এ দেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত।
তিনি নারী শিক্ষা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারীর স্বাধীনতা নিয়ে আজীবণ কাজ করে গেছেন। তার লেখনীতে তিনি যেমন নারীকে তার অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার হতে বলেছেন, তেমনি নারী যে কোনো ভোগের বস্তু নয় সে কথাও বলেছেন। বেগম রোকেয়ার অসামান্য আবদানের ফলে নারীরা আজ নানা প্রতিবন্ধকতার বেরাজাল থেকে বেরিয়ে সর্ব ক্ষেত্রে বিচরণ করছে এবং অবদান রাখছে দেশের উন্নয়নে। তার এই অবদানের জন্য আমাদের মাঝে তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মাসতুরা বিনতে মাহমুদ মোহনা বলেন, নারী শিক্ষায় বেগম রোকেয়ার অবদান অনেক। বর্তমানে নারীরা পড়ালেখা করছে, চাকরি করছে। অন্যদিকে এখনও নারীরা চার দেয়ালে বন্দি। কারণ তারা পুরুষের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে চায়। বেশির ভাগ নারী সংসারে ঝুঁকে পড়ছে। এটাতে স্বামীরা তাদেরকে বাধ্য করেছে নয়তো ইচ্ছে করেই ঝুঁকে পড়ছে।
নারীদের বুঝতে হবে যে তাদের কাজ শুধু সংসার করা না। তারা যদি শিক্ষিত না হয় তাহলে কোন কাজই ঠিক মতো করতে পারবে না। এজন্য তাদের প্রথমে নিজেদের বুঝতে হবে। সমাজে ছেলেরা যেমন চাকরি করতে পারে। তেমনি চাকরির ক্ষেত্রে উচ্চ স্তরে মেয়েদেরও যেতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবারের উচিত ছেলে মেয়েকে সমান ভাবা।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার লেখা 'সুলতানার স্বপ্ন' বেগম রোকেয়ার এক অনন্য সৃষ্টি। নারীবাদী সাহিত্যে, নারী চেতনার জাগরণে এটি অন্যতম রচনা। এছাড়া অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ, মতিচূর ইত্যাদি গ্রন্থেও তিনি তার চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন নিপুণভাবে।
বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন থেকে প্রসারিত হওয়া নারী অধিকার বাস্তবায়নের আজ অনেকটা পথ এগিয়ে চলেছে। যদিও সেই ভোগবাদী মানসিকতা আজো অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান, তবু নারী অধিকার আদায়ে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, সেকথা বলাই যায়। নারীদের মুক্তচিন্তার যে বীজ বেগম রোকেয়া তার কর্মে, তার সাধনায় বপন করে গেছেন আজ এবং আরো শত বছর পরও যে নারী সমাজ তা বহন করবে তা নিশ্চিত বলা যায়।
এএজেড