নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় যেন পারিবারিক পুনর্বাসন কেন্দ্র
শিক্ষক, কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী, কারো স্ত্রী, কারো ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা, বোনজামাই, শ্যালিকা কারোবা দেবর একই সাথে চাকরি করছেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের মধ্যে এমন আত্মীয়তার সম্পর্ক লক্ষ্য করা গেছে। কোন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেলে লিংক-লবিং এবং প্রভাব খাটিয়ে স্বজনদের চাকরি পেতে সহায়তা করছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ ও বিভিন্ন দপ্তরের কর্মযজ্ঞে স্বজনপ্রীতির এক বলয় গড়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন হয়ে উঠেছে পারিবারিক পুনর্বাসন কেন্দ্র। এই স্বজনদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহিত উল আলম এবং প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমানের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত।
শিক্ষকদের মধ্যে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এইচ এম কামালের স্ত্রী আফরোজা সুলতানা দোলন-চাঁপা হলে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাহবুব হোসেনের মেয়ে অন্তরা মাহবুব কর্মরত আছেন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে।
বর্তমান শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড.শেখ সুজন আলীর স্ত্রী ড. মোসাম্মৎ জান্নাতুল ফেরদৌস একই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল রানার স্ত্রী কর্মরত আছেন কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে। হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলামের স্ত্রী নিশাত নাবিলা কর্মরত আছেন বঙ্গমাতা হলের সেকশন অফিসার হিসেবে।
এছাড়াও নাট্যকলা ও পরিবেশনা বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দ মামুন রেজার স্ত্রী নুসরাত শারমিন তানিয়া একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে, সঙ্গীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুশান্ত কুমার সরকারের স্ত্রী ইন্দ্রানী কর্মকার একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে, থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্ট্যাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোঃ কামাল উদ্দীনের স্ত্রী ইসমতআরা ভূঁইয়া ইলা একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রণব কুমার মন্ডলের স্ত্রী শিলা সরকার পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের প্রভাষক হিসেবে, নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক জুয়েল মোল্যার শ্যালক মোঃরাহাত হাসান দিদার কর্মরত আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেজিস্ট্রার দপ্তরের সেকশন অফিসার মোঃআশিক সিদ্দিকির ভগ্নিপতি এ.কে. এম. আমিনুল হক চারুকলা বিভাগের সেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।অর্থ ও হিসাব দপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার রাজশ্রী সাঈদের বোন দেবশ্রী ব্যানার্জী কর্মরত আছেন রেজিস্ট্রার দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে। ভিসি দপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার মোঃজাকিবুল হাসানের স্ত্রী জাহানারা নেওয়াজ স্মৃতি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের সেকশন অফিসার, এবং বড় ভাই শারীরিক শিক্ষা দপ্তরে কর্মরত।
এছাড়া পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার মোঃলিয়াকত হাসানের স্ত্রী কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে, উপাচার্য দপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ জাহিদুল হোসেনের স্ত্রী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে, প্রকৌশল দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন কুমার শীলের স্ত্রী কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে, অগ্নিবীনা হলের সহকারী পরিচালক(অর্থ) এস এম কাউসার আহমেদের ছোট ভাই ডেমোনস্ট্রেটর হিসেবে, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের অতরিক্ত রেজিস্ট্রার(শিক্ষা) কৃষিবিদ আনিছুর রহমানের ভাই এস এম হুমায়ুন কবীর সহকারী রেজিস্ট্রার(এস্টেট) হিসেবে।
মেডিকেল সেন্টারের মেডিকেল এসিস্টেন্ট মোঃ রাশেদুল আলমের ভাই সোহাগ এবং শ্যালক মোঃরাজিবুল হাসান জনসংযোগ দপ্তরে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে, ফোকলোর বিভাগের পার্সোনাল অফিসার শহীদুল ইসলাম রানার ভাই রাশেদ মিয়া পরিসংখ্যান বিভাগের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি চালক নজরুলের অপর দুই ভাই মনির (গাড়িচালক) এবং কাহারুল অফিস-সহায়ক হিসেবে,লোক প্রশাসন বিভাগের মিলন এবং তার আরও দুই ভাই এই বিশ্ববিদ্যালয়েই কর্মরত আছেন।
এছাড়াও উপরে উল্লেখিত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাদেও এরকম আরও অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন যাদের রক্তের বা আত্মীয়তার সম্পর্কের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়েই কর্মরত আছেন। এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. শেখ সুজন আলী বলেন, স্বজনদের মধ্যে অনেকে চাকরি করতেই পারে, দেখার বিষয় হলো যেই পদে চাকরি করছেন সে সেই পদের যোগ্য কি না। যোগ্য হলে কোনো অসুবিধা নেই।
থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বঙ্গমাতা হলের প্রভোস্ট নুসরাত শারমিন তানিয়া বলেন, যদি কেউ নিজ যোগ্যতায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয় তাহলে কোনো সমস্যা থাকার কথা না। তবে অযোগ্য কেউ নিয়োগপ্রাপ্ত হলে সেবিষয়ে অবশ্যই তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।
রেজিস্ট্রার দপ্তরের সেকশন অফিসার আশিক সিদ্দিকী বলেন, আমার ভগ্নিপতি এখানে কোনো ধরনের আত্মীয়তার সম্পর্কের মাধ্যমে নিয়োগ পাননি। মেধার ভিত্তিতেই তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে উপরের উল্লিখিত অধিকাংশ শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর মন্তব্য জানতে চাইলে তারা সকলেই মেধার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন।
এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবির বলেন 'আমরা সেই বিবেচনা করে চাকরি দেইনি। যারা চাকরি নিয়েছে এটা তাদের বিষয় তবে অন্যত্র চাকরির সুযোগ থাকলে একই পরিবারের লোক একই প্রতিষ্ঠানে না আসাই ভালো'।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড.সৌমিত্র শেখর দে বলেন 'অতীতে কিভাবে নিয়োগ হয়েছে সেটাতো আমার জানা নেই। তবে এইরকম দৃষ্টান্ত আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে এটি বেশ আশ্চর্যের'।
এএজেড