আমরা বুড়িয়ে যাব থাকবে এই ক্যাম্পাস
ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্র ঐতিহ্যবাহী অক্সফোর্ড খ্যাত আমাদের আনন্দ মোহন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৮ সালে, সরকারিকরণ করা হয় ১৯৬৪ সালে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বৃহৎ পরিসরে না হলেও ১৬ একর নিয়ে সুন্দর মনোরম পরিবেশে গঠিত আমাদের শতবর্ষী এই ক্যাম্পাস। এই ক্যাম্পাসে প্রায় ৩৭০০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। চারটি অনুষদ ও একুশটি বিভাগ নিয়ে সুন্দর পরিপাটি ক্যাম্পাস। কলেজ প্রাঙ্গণে আছে সুবিশাল মাঠ, মাঠের এক পাশে আছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্ত মঞ্চ যেখানে সকাল থেকে রাত ক্লান্তিহীনভাবে চলতে থাকে গান, আড্ডা, আবার ও চলে প্রিয়জন সমাগম। মাঠের পাশেই ছাত্রীদের হল, কলেজের মাঠের ক্যাম্পাসের সামনে মুক্তমঞ্চের পাশে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসের ফাঁকে চায়ের আড্ডা হয়, স্বতঃস্ফূর্তায় পূর্ণ থাকে কলেজ প্রাঙ্গন। প্রতিদিন রচিত হয় কত গল্প, আর যারা চলে যায় রেখে যায় কত আবেগ কত স্মৃতি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আমাদের ক্যাম্পাসের মুগ্ধতায় ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,
“ তোমাদের সামনে জ্ঞানের সোপান পড়ে রয়েছে,
উচ্চতম সোপানে আরোহন করে
জ্ঞানের সার্থকতা বিধান কর”
এই ক্যাম্পাসে অধ্যয়ন করে আবার এই ক্যাম্পাসের শিক্ষক হয়ে ফিরে আসছেন অনেকে, তাদের চিরচেনা সেই স্মৃতিবিজড়িত প্রাণের ক্যাম্পাসে।
ক্যাম্পাসের দিনগুলি যেন বন্ধু ছাড়া কেবল এক নির্জন ভূমি ছাড়া আর কিছুই না। অঞ্চল, সংস্কৃতি, জাতি, ধর্মকে উপেক্ষা করে বাঁচার নামই তো বন্ধুত্ব। বন্ধু মানে কিছু স্বপ্নের ভাগাভাগি, বন্ধু মানে ঝগড়ার পর কাঁধে কাঁধ রাখা। ‘বন্ধুত্বের সম্পর্কই সবচেয়ে মধুর সর্ম্পক।
একজন মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলো হল স্কুল জীবনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে স্নাতকের জীবন। এই চারটি বছরে আমরা পেয়েছি অসংখ্য স্মরণীয় স্মৃতি। আছে আনন্দ-উল্লাসের গল্প, একইসঙ্গে আছে কিছু বেদনার কাব্য। আমরা জীবনের অনেক কিছুই ভুলে যেতে পারি কিন্তু এই চারটি বছরের কথা বারবার আমাদের জীবনের গল্পে আসবেই।
ক্যাম্পাসে আসার পর ছিল সব নতুন নতুন মুখ, সবাই অচেনা, এই অচেনা মানুষগুলোই এক সময় একসুতোয় বাঁধা পড়ে যায়।
আমার জীবনে সব চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ছিল ক্যাম্পাসের “কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার” যাকে আমরা দুষ্টামি করে ‘কারাগার’ বলে ডাকতাম, ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ‘গ্রন্থাগার’ এ আছে ৫০০০০ এর ও বেশি বই, এমন অনেক পুরনো বই আছে যেগুলো আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কে মনে করিয়ে দেয়। গ্রন্থাগার এর সামনে বসে আড্ডা দিতাম, জোরে জোরে কথা বলতাম আর ভাইয়া, আপুদের দের বকুনি, তবুও যেন এইগুলো ছিল আমাদের কাছে সেরা আনন্দঘন মুহূর্ত, প্রতিদিন সকালে প্রাইভেট শেষ করে ক্লাস করার আগে ক্যান্টিন এ গিয়ে ডাল, পরোটা আর দারুচিনির চা, উফফফ কি দিন ছিল, যদি ও এই পরোটা খেলে আমার খুব ঘুম পেত, তবুও বড্ড মিস করি সেই ঘুম জড়ানো পরোটা আর এই দারুচিনির চা, শহীদ মামার লোভনীয় ঝাল ঝাল ফুচকা অসাধারণ।
ক্যাম্পাস এর মজাটা প্রথম বর্ষ আর দ্বিতীয় বর্ষ অবধি ছিল, তারপর আস্তে আস্তে কলেজ যাওয়া কমে যায়, আড্ডা হত বাহিরে, মুক্ত মঞ্চের সামনে, বিকাল বেলা কলেজ মাঠে যে আড্ডা টা জমে উঠে সেটা আমার কাছে বৈশাখী মেলার মত মনে হয়, ছোট ছোট করে গোল বৈঠক যেখানে কেউ কেউ গিটার এর তালে তালে গলা ছিঁড়ে গান গায়, আবার ও কেউ কেউ একসাথে বসে গ্রুপ স্টাডি করে, আবার কেউ কেউ সুখ-দুঃখের কথায় হারিয়ে যায়।
শেষ বর্ষে এর সব চেয়ে সেরা মুহূর্তটা থাকে শিক্ষা সফর, যারা এইটা মিস করে তাদের জীবন এ ক্যাম্পাস জীবন সবচেয়ে বেশি অপূর্ণ থাকে, ,সাতটা দিন একসাথে থাকা, সাগর, পাহাড় সব কিছু একসাথে উপভোগ করার এটাই সবচেয়ে উত্তম সময় থাকে, আমাদের জীবনে ও ব্যতিক্রম ঘটেনি, সফর এ যাওয়ার পর আমাদের বন্ডিংটা এত শক্ত হয় যে, মনে হয়েছিল আরো দুই তিনটে বছর এই ক্যাম্পাসে থেকে গেলে মন্দ হতো না,,,
ক্যাম্পাস হচ্ছে স্বপ্ন বাস্তবায়নের যথার্থ মাধ্যম যদি আমরা ক্যাম্পাসের সময়টাকে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করতে পারি। সবার স্বপ্ন যেন সিঁড়ি মাড়িয়ে আকাশের দিকে চলছে। স্বপ্ন সাদা মেঘের সাথে ভাসার। ক্যাম্পাস বন্ধু, আড্ডা ছাড়া শিক্ষা জীবন চলে না।
শিক্ষাগুরুদের কথা বলা যাক, যাদের শাসন, স্নেহ আমাদের আজ এই অবধি নিয়ে এসেছে। এই ক্যাম্পাসে ১৯৫ জন শিক্ষাগুরু রয়েছেন যারা তাদের সব টুকু দিয়ে আমাদের শিক্ষাদান করে আসছেন।
কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আমান উল্লাহ স্যার যিনি সব সময় সুশৃঙ্খল ভাবে কলেজ পরিচালনা করে আসছেন, উপাধ্যক্ষ মো. নুরুল আফছার স্যার যিনি আমাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরন করে আসছেন, আমার বিভাগীয় শিক্ষাগুরু, বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর আব্দুল হামীদ স্যার যিনি যেকোন সমস্যায় সুন্দর ভাবে সহজ করে সমাধান দিয়ে থাকেন।স্যার এর সুস্পষ্ট ভাষা গুলো আমাদের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়।
আরিফ স্যার যিনি দেখা হলেই মিষ্টি হাসি দেন।
শাহিন স্যার, রানা স্যার, শিপন স্যার তো মাটির মানুষ, যাদের কাছে নির্দ্বিধায় সব বায়না গুলো করা যায়।
শামছুজ্জামান স্যার, যিনি রোভার স্কাউটের আমাদের ক্যাম্পাসের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। স্যারদের ক্লাস করলেই মন জুড়িয়ে যায়, আশীষ ব্রত স্যার এর ক্লাসের ফাঁকে স্যারের পড়া বই এর বেস্ট কিছু কথা, মাঝে মাঝে খালি গলায় গান, ফিরোজ স্যার যদি ও গম্ভীর মানুষ, কিন্তু কথা বলেন সরাসারি, সেই সাথে নিলুফা মেডামের সব কিছুতে সহজ করে দেওয়া যেকোন বিষয়, প্রশান্ত স্যার খুব মিষ্টভাষী, কনিকা ম্যাম খুবই বিনয়ী, খালেদ স্যার যদিও শাসন করেন বেশি আবার সোহাগটা ও বেশি করেন, সাবিরা ম্যাম এর সুন্দর ক্লাস। মোট কথা সব কিছুই মনোমুগ্ধকর। স্যার মেডামদের শাসন, ভালোবাসা গুলোই আমাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত।
এমবিএ পড়ার সুবাধে পুনরায় প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসা, আবার নতুন করে চায়ের চুমুকে আড্ডা জমে, পুরানো বন্ধুগুলো ছাড়া আবার ও পেয়েছি নতুন মুখ, নতুন নতুন বন্ধু বান্ধবী।
বন্ধু সংখ্যা নিয়ে ডানবার সংখ্যাতত্ত্ব বলে একটা চমৎকার থিউরি আছে। এই থিউরি মতে ‘একটা মানুষের জীবনে ১৫০ জন সাধারণ বন্ধু থাকে অর্থ্যাৎ মানুষের মস্তিষ্ক ১৫০ জন মানুষের সঙ্গে সাধারণ যোগাযোগ রাখতে পারে। এদের মধ্যে ৫ জন ঘনিষ্ঠ, ১৫ জন সেরা, ৫০ জন ভালো বন্ধু।’ হয়তো নিয়মিত যোগাযোগের কারণেই ভালো বন্ধুর সংখ্যায় ক্যাম্পাসে গড়ে ওঠা বন্ধুদের নামই বেশি।এইভাবেই চলতে থাকবে আমাদের বন্ধুত্বের অধ্যায়গুলো, যেগুলো আমাদের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে।
এইভাবেই দীর্ঘ সময়ের যাত্রা পথে গতি পরিবর্তন হয়ে যায়, কিন্তু আমরা ছাত্র -শিক্ষক মিলিত হই আবার বিভিন্ন অনুষ্ঠান, কিংবা কখনো মিলনমেলায়।
আজ থেকে ২০ বছর পর যখন বুড়িয়ে যাব তখনও সেভাবেই থাকবে এই ক্যাম্পাস । হয়তো অনেকেই থাকবে না আমাদের মাঝে। মনে পড়বে যখন সে কথা, স্মৃতিচারণে হয়তো তখন আবার সেই প্রচণ্ড প্রাণচঞ্চল তারুণ্যে না হয় ফিরেই যাওয়া যাবে।
তাই শরদিন্দু কর্মকার এর ভাষায়,
"হারাতে কিছু ইচ্ছে করে না
মায়ের ভালোবাসা, বাবার স্নেহ
প্রিয়জনের প্রেম, আরো কত কি!
ধর্মের বাণী,বহু কষ্টে অর্জিত শিক্ষা
স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি
দু হাতে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে বুকের মাঝে।"
তেমনই ভাবে আমরা ও হারাতে চাই না প্রিয় ক্যাম্পাসে থাকা সেই দিনগুলো।
লেখক: ফারিয়া দিলশাদ মীম, মাস্টার্স শেষ বর্ষ(এম.বি.এ)
ব্যবস্থাপনা বিভাগ, আনন্দ মোহন কলেজ,ময়মনসিংহ