অফিস সহকারী থেকে সহকারী অধ্যাপক!
এইচএম আনিসুজ্জামান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস সহকারী থেকে সহকারী অধ্যাপক। কেবল তাই নয় নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী একজন ছাত্রীর সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ ফোনালাপের অভিযোগ উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহকারী অধ্যাপকের বিরুদ্ধে।
তার এই আলোপের রেকর্ড ছড়িয়ে গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অভিযুক্ত অধ্যাপক গোপালগঞ্জের এই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির কৃষি বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এই জঘন্য ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের সভাপতির বিপক্ষে একের পর এক অভিযোগগুলো সামনে আসতে থাকে। ফলে তার বিরুদ্ধে এটিই প্রথম অভিযোগ নয়। ২০১৯ সালে, আজ থেকে চার বছর আজে তিনি এই বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব লাভ করেন। এরপর থেকে এইচএম আনিসুজ্জামানের বিপক্ষে একের পর এক অভিযোগ করেছেন ছাত্র, ছাত্রীরা।
ছাত্র, ছাত্রীদের অভিযোগ-তিনি নিয়ম-নীতি ডিঙিয়ে শিক্ষকতা পেশায় ক্ষমতা দেখিয়ে এগিয়েছেন। নানা অভিযোগ আসার পরও প্রভাবশালী মহল বিশেষের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের জোরে আগের মতো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, নেওয়াও হয়নি। এমনকি ছাত্রীর সঙ্গে কুরুচিময় এই ফোনালাপের পরেও এইচএম আনিসুজ্জামানের বিপক্ষে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্র, ছাত্রী ও সংশ্লিষ্টরা।
সেই ছাত্রীকে তিনি আলাদাভাবে একাকী সময় কাটাতে জোরাজুরি করেছেন। একাধিকবার এমন অন্যায় ও কুরুচিময় আচরণ করেছেন এইচএম আনিসুজ্জামান। তবে বারবার ছাত্রীটি তার বাজে প্রস্তাবে সায় দিতে অস্বীকার করেছেন। এরপর কৃষি বিভাগের চেয়ারম্যান বা সভাপতি তাকে নানা ধরণের ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। তাদের এই আলাপের সময় পরীক্ষার আছে ছাত্রীকে প্রশ্ন দিয়ে দেবার অভিযোগ আছে তার বিপক্ষে। উত্তরে নম্বর বাড়িয়ে গিয়েছেন তিনি-এমন অভিযোগ আছে।
এই বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেছেন, ‘শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হলেন মহান মানুষ। তবে আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এইচএম আনিসুজ্জামান ব্যতিক্রম। তিনি নানা সময়ে একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে জোর করে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি শিক্ষাথীদের সঙ্গে বৈষম্যে ভরা আচরণ করেন। অনেকের পরীক্ষার খাতায় নাম্বার তার ইচ্ছেতে বাড়ে ও কমে।’ ফলে মোট তিনটি অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ আছে সহকারী অধ্যাপক এইচএম আনিসুজ্জামানের বিপক্ষে।
প্রথমটি হলো ছাত্রীর সঙ্গে একাকী সময় কাটানোর ইচ্ছে ও এই ফোনালাপ ফাঁস, দ্বিতীয়টি হলো-ছাত্র, ছাত্রীদের সঙ্গে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ, উত্তরপত্রে নম্বর বেশি ও কম দেওয়া। প্রচণ্ড ক্ষোভে রয়েছেন বিভাগীয় সভাপতির অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ ও কাজগুলো এবং অনৈতিক কর্মগুলোতে ছাত্র, ছাত্রীরা। তবে ছাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের বিষয়ে বেশিরভাগ মেয়েই পরীক্ষার ফলাফল ও ভবিষ্যত জীবনের সাটিফিকেটের ভয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন। তারা কথা বলতে চাইছেন না। তারা এইচএম আনিসুজ্জামানের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন।
জানিয়েছেন গণমাধ্যমকে, কৃষি বিভাগের সভাপতি ও সহকারী অধ্যাপক এইচএম আনিসুজ্জামানের বিপক্ষে সরাসরি কোনো কথা বলতে গেলে আমাদের ওপর নানা ধরণের চাপ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি প্রভাবশালী বলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত। এই বিষয়ে বর্তমান প্রতিবেদক অভিযুক্ত অধ্যাপক এএইচএম আনিসুজ্জামানের মুখোমুখি হয়েছেন। তবে বিভাগীয় প্রধান ও অন্যতম এই শিক্ষক বলেছেন, ‘এইসবগুলো পুরোপুরি বানোয়াট। আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না। কোনো স্বার্থান্ধ মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ মিথ্যাচার ছড়িয়েছে।’
এরপর তার অনুষদ ‘কৃষি’র ডিন অধ্যাপক ড. মো. মোজাহার আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। তিনি বলেছেন, ‘এই বিষয়ে অফিশিয়ালি এখনো পর্যন্ত কোনো লিখিত তথ্য পাইনি। কৃষি বিভাগের সভাপতি ও সহকারী অধ্যাপক এইচএম আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে পরীক্ষায় অনিয়মের বিষয়টি সত্য। সেই অনিয়ম অন্যান্য শিক্ষকের সম্মতিতে সংশোধন করা হয়েছে।’ ছাত্রীর সঙ্গে ফোনালাপ ফাঁসের ও পরীক্ষায় অনিময় এবং খারাপ আচরণের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রাজিউর রহমান বলেছেন, ‘কৃষি বিভাগের সভাপতি ও সহকারী অধ্যাপক এইচএম আনিসুজ্জামানের বিষয়ে আমার কাছে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি। পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’
এই ঘটনায় বিভিন্ন পত্রিকা ১৯ জানুয়ারি সংবাদ প্রকাশ করেছে। এরপর তার বিভাগের ছাত্র, ছাত্রীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। ২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে। তারাও প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন। তারপর ছাত্র, ছাত্রীরা তার অব্যাহতি চেয়ে রেজিস্টার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। ফলে ২৫ জানুয়ারি, ২০২২ তারিখে কৃষি বিভাগের সভাপতির পদ থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সহকারী অধ্যাপক এইচএম আনিসুজ্জামানকে। এখন কৃষি অনুষদের ডিন এই বিভাগের অধ্যাপকের অতিরিক্ত দায়ত্ব পালন করছেন।
এরপর আজ বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এইচএম আনিসুজ্জামানের একজন ছাত্রী যৌন হয়রানির লিখিত অভিযোগ করেছেন এবং এই অভিযোগের ভিত্তিতে তারা তদন্ত কমিটি তৈরি করেছেন। তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত এইচএম আনিসুজ্জামান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিতে ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল একজন অফিস সহকারী হিসেবে হিসাব দপ্তরে যোগ দিয়েছেন। এরপর ২০১৬ সালের ১১ জুন কৃষি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। অভিযোগ আছে, এরসবই তার প্রভাবশালী মহল ও প্রভাবের কারণে ঘটেছে। তিনি বিভাগীয় সভাপতিও একইভাবে হয়েছেন। তবে একজন অফিস সহকারী বা পিয়নের প্রভাষক পদে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের রেকর্ড বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।
অফিস সহকারী থেকে বিভাগীয় প্রধান হওয়া এইচএম আনিসুজ্জামানের বিপক্ষে অসদাচরণ ও চরম অন্যায় ঘটনাগুলোর তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশের অন্যতম সরকারী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি। ইংরেজি বিভাগের সভাপতি ও সহকারী অধ্যাপক মো. আশিকুজ্জামান চার সদস্যের এই বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটির প্রধান।
এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. মোরাদ হাসান বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের যথাথ অধিকার আদায়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বদ্ধপরিকর। শিক্ষার্থীদের আনীত অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা এইচএম আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
এই তদন্ত কমিটির প্রধান ও ইংরেজি বিভাগের সভাপতি আশিকুজ্জামান ভুঁইয়া বলেছেন, ‘এইচএম আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে আমার কাছে নোটিশ এসেছে। আশা করি কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে কাজের মাধ্যমে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। কৃষি বিভাগের সাবেক সভাপতি ও সহকারী অধ্যাপক এইচএম আনিসুজ্জামানের বিভিন্ন অনৈতিক ও অন্যায় আচরণগুলোতে ছাত্র, ছাত্রীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। তবে তার বিপক্ষে ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই পরীক্ষার ফল ও সার্টিফিকেটের জন্য মুখ খোলা ও এই বিষয়টি এড়িয়ে চলেছেন। তার ভয়ে অনেক ছাত্র, ছাত্রী কথা বলতে চান না। তারা বলেছেন, ‘এইচএম আনিসুজ্জামানের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো কথা বলতে গেলে আমাদের ওপর নানা ধরণের ভয়াবহ চাপ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।’
ওএস/