নানা সমস্যায় জর্জরিত চবির ছাত্র হল
নানা সমস্যায় জর্জরিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক হলগুলো। আলু, পেঁপে, গাজর ও আলু ভর্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খাবার। নেই কোনো বৈচিত্র্যতা। আবার গতিবিহীন ইন্টারনেট সংযোগ, মশা-মাছির উৎপাত, ভবনের বিভিন্ন রুমের ছাদ থেকে পলেস্তরা খসে পড়া, ভালো মানের রিডিং রুমের ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো।
কর্তৃপক্ষের সঠিক তদারকির অভাবেই শিক্ষার্থীরা এমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অজুহাতে হলের ডাইনিংয়ে নিম্নমান ও অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। এমনকি আবাসিক হলগুলোর ডাইনিংয়ে গড়ে ৩০০ শিক্ষার্থীর জন্য রান্না করা হয় মাত্র এক কেজি ডাল। গামলা ভরা পানিতে হলুদ আর তেলের পাতলা স্তর দেখে বোঝার উপায় নেই, তা ডাল নাকি থালাবাটি ধোয়া পানি।
এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না এবং নোংরা পানিতে প্লেট ও গ্লাস পরিষ্কারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে হলগুলোর ডাইনিং ও ক্যাম্পাসের খাবারের দোকানগুলো নিয়ে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বাজারের সবচেয়ে নিম্নমানের চাল ও কমদামে সবজি কিনে ডাইনিং ও খাবার দোকানগুলোতে রান্না করা হয়।
জানা যায়, বাজারের দর বিবেচনা করে এক বেলা খাবারের মূল্য ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা নির্ধারণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রভোস্ট কাউন্সিল। কিন্তু এতেও খাবারের মান বৃদ্ধি পায়নি। বরং শুরু হয়েছে ২৫, ৩০, ৩৫ ও ৫০ টাকার নতুন ব্যবসা। ফলে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে একটু ভালো খাওয়ার আশায় চড়া মূল্যের এই খাবার গ্রহণ করছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সকলেই যেন বেশি মূল্যের খাবার গ্রহণ করে, তাই ২৫ টাকার খাবার ইচ্ছে করেই খারাপ করে কর্মচারীরা। ২৫ টাকার টোকেনে নিত্যদিন আলুর সঙ্গে থাকে এক টুকরো মাছ, এক টুকরো ব্রয়লার মুরগীর মাংস। খাবারে নেই বৈচিত্র্যতা। প্রত্যেকদিন আছে গাজর আর শীত চলে গেলেও এখনও আমাদের ফুলকপি, বাঁধাকপির তরকারি খেতে হয়।
হলগুলোর ডাইনিং ম্যানেজাররা বলেন, বাজারে দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা কী করব? তাদের অভিযোগ অনেকে আছে খাবার খেয়ে টাকা দেয় না। টাকা চাওয়া হলে আমরা তাদের কাছে প্রায় কর্কশ ব্যবহারের শিকার হই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মেহেদি হাসান শাওন বলেন, রাত ৮টার পরে ডাইনিংয়ে খাবার পাওয়া যায় না। ফলে যারা টিউশনিসহ বিভিন্ন কাজ সেরে একটু রাতে রুমে ফেরেন তাদের খাবার জন্য ছুটতে হয় অন্য কোথাও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হলের একাধিক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, যে পরিমাণ রাউটার প্রয়োজন তার ব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক রুম ইন্টারনেটের আওতায় আসে না।
রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুকণ্ঠ সরকার বলেন, 'যদি হলের ডাইনিংগুলো এ রকম চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী চলতে থাকে তাহলে সামনে রমজান মাসে রোজা থাকব কীভাবে। এই বিষয়গুলো আমাদের নিয়মিত ভাবিয়ে তোলে। পুরো রমজান মাস ক্লাস, টিউশন বাদ দিয়ে বাড়িতে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। আমরা চাই প্রশাসন এ ব্যাপারে একটু যত্নবান হউক।'
গবেষকরা বলছেন, হলের একজন শিক্ষার্থী দৈনিক গড়ে পুষ্টি পান ১ হাজার ৮২১ কিলোক্যালরি। অথচ একজন সুস্থ মানুষের প্রয়োজন ২ হাজার ৮০০ কিলোক্যালরি। এর কম পেলে তাকে দারিদ্র্য সীমার নিচে ধরা হয়। পুষ্টি গ্রহণের বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দারিদ্র্য সীমার নিচে থেকেই উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছেন।
ভবনের মধ্যে অনেক জায়গার ছাদ থেকে পলেস্তরা খসে পড়ে ইট-সুরকি ও রড বেরিয়ে গেছে। এ ছাড়া ফাটল ধরেছে প্রায় বেশ কিছু স্থানে। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে আলাওল হল একটু ঝুকিপূর্ণ বিধায় গত বছরের ২৬ নভেম্বর ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে এক শিক্ষার্থী দুই তলা থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আহত হন। তা ছাড়া হলের ডাইনিং ও টিভি রুমের ছাদের পলেস্তার খসে পড়ে রড বের হয়ে গেছে। একই রকম চিত্র স্যার এ এফ রহমান হলের হলের মসজিদে ও রিডিংরুমে।
আলাওল হলের অবকাঠামো নিয়ে প্রভোস্ট প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফরিদুল আলম বলেন, হলটা ৫০ বছরের পুরাতন। তাই কিছু জায়গায় পলেস্তার খসে পড়েছে। আমরা হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় প্রশাসন এর অনুমোদন দিয়েছে। টেন্ডার পাস হলে দ্রুত কাজ শুরু হবে।
ইন্টারনেট গতির সমস্যা নিয়ে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমার কাছে মনে হচ্ছে না এটা একটা বড় সমস্যা। তা ছাড়া আমাদের হলের ফান্ডের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই আমরা দ্রুত সমাধান করতে পারছি না।
খাবারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয় অন্যান্য হল থেকে এই হলের খবার তুলনামূলক ভালো। আমি নিজেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ডাইনিংয়ে খেয়েছি। তবে যদি আর একটু উন্নত করতে হয় তাহলে পাঁচটাকা বা দশটাকা বাড়ালে একটু ভালো মানের পাওয়া যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. বেনু কুমার দে বলেন, 'হলের খাবারের মান নিয়ে এত প্রশ্ন কেন? ২৫ টাকার খাবারের মান এর থেকে আর কী ভালো হতে পারে। হলের ডাইনিং ম্যানেজাররা কী তাদের বাড়ি থেকে এনে দিবে খাবার। ছাত্ররা ২৫ টাকার, ৫০ টাকার কফি খায় তখন কোনো প্রশ্ন আসে না আর হলের খাবার নিয়ে এত প্রশ্ন। বাড়িতে কী ২৫ টাকার খাবার খাওয়া যায়? যদি এতই সমস্যা থাকে তাহলে শিক্ষার্থীদের ডাইনিংয়ের দায়িত্ব নিতে হবে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বা পরিচ্ছন্নতার বিষয় আসলে বলেন ২৫ টাকায় এর থেকে বেশি স্বাস্থ্যকর বা পরিচ্ছন্নতা পাওয়া যায় না।'
এসয় ভতূর্কির বিষয়ে বলেন, সরকার কোনো ভর্তূকি দেয় না। যদি হলের শিক্ষার্থীদের ভর্তূকি দিতে হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ হাজার শিক্ষার্থীকে ভর্তূকি দিতে হবে। সবার অধিকার আছে হলে থাকার। আমরা তো সবাইকে সিট দিতে পারছি না।
আলাওল হলের অবকাঠামো নিয়ে বলেন, হলটা যদি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাহলে এটা অডিটোরিয়ামের মতো পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। আমি ইঞ্জিনিয়ার পাঠাব পরিদর্শনের জন্য। পলেস্তার খসে যদি রড বের হয়ে যায় এটা বাদ দিয়ে নতুন হল বরাদ্দ দিতে হবে।
টিটি/