অ্যান ডি হেনিং এর তোলা মুক্তিযুদ্ধের কিছু অদেখা ছবি
আঁটি বাঁধা তীর। বাঁশ-দড়ি দিয়ে তৈরি ধনুক। তীরগুলোও বাঁশের তৈরি। আর যাদের হাতে তীর-ধনুক, তাদের কারও মুখের কাঁচা-পাকা দাড়ি বা বলি রেখা জানান দিচ্ছে বয়স পেরিয়েছে পঞ্চাশ। আবার তাদের একই কাতারে তীর-ধনুক তাক করে দাঁড়ানো শিশুটির বয়স হয়তো ১২। তাদের একজনের পরনে খাকি কাপড়, আবার কারও পরনে সাধারণ লুঙ্গি।
মুক্তিযুদ্ধের একদম শুরুর দিকে মাত্র ১৫ দিনের মাথায় ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল এই ছাবিটি তোলা হয়েছে রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলা থেকে। ঠিক তার একমাস দুই দিন আগে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে, শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’ অক্ষরে অক্ষরে পালনের প্রতিচ্ছবিও যেন ছবিটি। না হয় প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদের অতি সাধারণ ছেলে-বুড়োরা বাঁশের তৈরি তীর-ধনুক নিয়ে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীকে মোকাবেলার মন্ত্র পেল কোথা থেকে!
মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরল এমন অনেক ছবি তুলেছিলেন ফরাসি আলোকচিত্রী অ্যান ডি হেনিং। বর্তমানে ৭৬ বছর বয়সী এই নারী শিল্পীর বয়স তখন ছিল মাত্র ২৫। ২৩ বছর বয়সে নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন যুদ্ধের ছবি তুলতে। সেখান থেকে ছুটে এসেছিলেন সদ্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের ছবি তুলে তা বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণি’ বাংলার পথে-প্রান্তরে প্রত্যক্ষ করেছিলেন অ্যান ডি হেনিং। কিন্তু দেখা হয়নি সেই মুজিবকে। তবে ঠিক এক বছর পর, ১৯৭২ সালে হেনিং আবার বাংলাদেশে আসেন।
এবার আসেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আওয়ামী লীগ কাউন্সিল মিটিংয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেবেন খবর পেয়ে। যে মানুষটি এতো বছর ধরে বাঙ্গালি জাতির জন্য এবং যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন, এখন আবার একটি নতুন জাতির প্রধানমন্ত্রী, তাকে দেখার আগ্রহ দমন করতে পারেননি তিনি।
’উইটনেসিং হিস্ট্রি ইন দ্য মেকিং ফটোগ্রাফস বাই অ্যান ডি হেনিং’ শিরোনামে এক প্রদর্শনীতে হেনিংয়ের তোলা সেসব ছবি প্রদর্শন করা হয়।
রাজধানীর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এবং সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। প্রদর্শনী চলবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে, সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এই আয়োজন করেছে। আয়োজকরা জানান ফরাসী ফটোগ্রাফার অ্যান ডি হেনিংয়ের ৭১-৭২ সালের বাংলাদেশের অপ্রদর্শিত ছবি প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন রুক্সমিনি রিকভানা কিউ চৌধুরী।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাতির পিতার ছবিগুলি পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল এবং বেঁচে যাওয়া ছবির মধ্যে হেনিংয়ের তোলা বঙ্গবন্ধুর রঙিন ছবিগুলো অন্যতম।
প্রদর্শনীতে অ্যান ডি হেনিংয়ের ছবি ছাড়াও বিভিন্ন ছবির প্রেক্ষাপট লিপিবদ্ধ করে প্রদর্শন করা হয়। এতে বঙ্গবন্ধুর রঙ্গিন ছবি তোলার প্রেক্ষাপটও তুলে ধরা হয়। যাতে লেখা হয়, ‘যদিও সেই সময়ে তিনি সাদা-কালো আলোকচিত্রের প্রতি বেশী দুর্বল ছিলেন, তবে শামিয়ানার প্রাণবন্ত নীল, সাদা এবং লাল স্ট্রাইপের কারণে একটি গতিশীল এবং শক্তিশালী পরিবেশ তৈরি করে, তা দেখে অ্যান রঙ্গিন ছবি তুলতে আগ্রহবোধ করেন।’
এমএ/এএস