কাগজের মূল্যবৃদ্ধি: একুশে বইমেলা নিয়ে ১৬ প্রস্তাবনা
কাগজের মূল্যবৃদ্ধিতে সংকটে রয়েছে প্রকাশনা শিল্প। আর তাই আগামী বছরের একুশে বইমেলা নিয়ে ১৬টি প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ লেখক পাঠক প্রকাশক পরিষদ।
শনিবার (২৬ নভেম্বর) বাংলাদেশ লেখক পাঠক প্রকাশক পরিষদের উদ্যোগে পাঠক সমাবেশ কাঁটাবন কেন্দ্রে 'কাগজের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটে প্রকাশনা শিল্প: একুশে বইমেলা ২০২৩ নিয়ে আমাদের প্রস্তাবনা' শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
পরিষদের আহ্বায়ক শ্রাবণ প্রকাশনীর রবীন আহসান ১৬ দফা প্রস্তাবনা পাঠ করেন। সদস্য সচিব কবি ও সংগঠক নীলসাধুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাবেক সভাপতি আলমগীর সিকদার লোটন, এক রঙা এক ঘুড়ি প্রকাশনীর শিমুল আহমেদ, কথাসাহিত্যিক নির্মাতা রেজা ঘটক, আনন্দম প্রকাশনীর শ্রাবণী, উত্তরণ প্রকাশনী আহমেদ মাসুদুল হক, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক আকরামুল হক, সোহরাব হোসেন প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, অমর একুশে বইমেলা দেশের বই, পাঠক, লেখকসহ বাঙালির জন্য একটি বিশেষ উপলক্ষ। একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। ফেব্রুয়ারিজুড়ে এই মেলা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বেই এখন একটি অনন্য ঐতিহ্য।
তারা বলেন, গত দুটি বইমেলা করোনা মহামারির কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লেখক, পাঠক, প্রকাশকসহ সবার জন্যই এই সময়কাল কঠিন ছিল। সম্প্রতি আবার অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাসের কারণে আসন্ন অমর একুশে বইমেলা আয়োজন করার প্রাক্কালে আমাদের অনেক বিষয়াদি বিবেচনায় নিতে হবে। কাগজ সংকটের কারণে দেশে এখন মুদ্রণ কাজই থমকে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এ বছর বইয়ের দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রবল। গত ৬ মাসের মধ্যে পাইকারিতে প্রতি টন কাগজের দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। গত বছর যে কাগজের রিম ১ হাজার ৭০০ টাকা ছিল, এবার সেটি ৩ হাজার ৪০০ টাকা হয়ে গেছে। অন্য কোনো সেক্টরে পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়নি, অথচ কাগজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেল।
বক্তারা আরও বলেন, আমরা দেখেছি বইমেলা আর পাঠ্যবই ছাপার সময় এলে মিলমালিকরা একত্রিত হয়ে কাগজের দাম বাড়াতে থাকে। এর অবসান হওয়া উচিত। একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের বই-পাঠক-প্রকাশক-লেখক তথা সংস্কৃতজনদের মাঝে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। আয়োজক বাংলা একাডেমিকে তাই একুশে বইমেলা আয়োজন সফল করতে বাংলাদেশ পুস্তক, প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতিসহ সমমনা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে।
প্রস্তাবনাগুলো হলো-
১. করোনা মহামারি ও সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দায় প্রকাশনা শিল্পের ক্ষতির কথা বিবেচনায় নিয়ে আসন্ন একুশে বইমেলায় স্টল ভাড়া সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি আমরা।
২. আমরা দেখেছি বইমেলা আর পাঠ্যবই ছাপার সময় এলে মিলমালিকরা একত্রিত হয়ে কাগজের দাম বাড়াতে থাকে। এর অবসান হওয়া উচিত। সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
৩. গত তিন বছর করোনা মহামারির ফলে দেশের প্রকাশনা শিল্প ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাবও পড়েছে দেশে। কাগজসহ প্রকাশনা সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক সবকিছুর (প্লেট, ছাপা, বাঁধাই) মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। দুই বইমেলায় প্রকাশকরা আছেন লোকসান ও ক্ষতির মুখে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ লেখক পাঠক প্রকাশক পরিষদের প্রস্তাবনা হচ্ছে আসন্ন অমর একুশে বইমেলা ছোট পরিসরে আয়োজন করতে হবে।
৪. করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, ডলারের অস্বাভাবিক দাম, চলমান অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে পাঠক, লেখক, প্রকাশক সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। দৈনন্দিন দ্রব্যাদি ও অন্যান্য সাংসারিক প্রয়োজন মিটিয়ে বই কেনার সামর্থ্য এবার কতজনের থাকবে সেটা একটি প্রশ্ন। পাঠকদের সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে প্রকাশকরা বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করবেন। একজন পাঠক যেন তার পছন্দের বইটি সংগ্রহ করতে পারে এটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
৫. কাগজ সংকট ও অন্যান্য কারণে বই প্রকাশের সংখ্যা কমে গেলে লেখক, কবি সাহিত্যিক যারা আছেন তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাংলাদেশে রয়্যালটি প্রদান নিয়ে লেখকদের নানা আপত্তি রয়েছে। বাংলাদেশ লেখক পাঠক প্রকাশক পরিষদ আশা করে প্রকাশনা সংস্থাগুলো লেখকদের রয়্যালটি প্রদানে স্বচ্ছতা বজায় রাখবেন।
৬. একুশে বইমেলা-২০২৩ এর একটি খসড়া লে-আউট প্রদর্শন করছি। এই লে-আউটটিকে আদর্শ ধরে নিয়ে মেলার ডিজাইন করতে হবে। সেক্ষেত্রে মেলার পরিসর ছোট হয়ে আসবে এবং পাঠক ও মেলায় আগতদের জন্য স্টল ও পুরো মেলা ঘুরে দেখার সুযোগ বাড়বে। প্রকাশকরা সবাই লাভবান হবে।
৭. বইমেলায় নিরাপত্তার ইস্যুটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতে হবে এবং মেলায় আগতদের প্রবেশ ও বাহির পথে চারদিকে ট্রাফিক কন্ট্রোল সুশৃঙ্খল যথাযথ করতে হবে। ছুটির দিনে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। গাড়ি, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল ইত্যাদি যানবাহন পার্কিংয়ের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৮. উদ্যানের পূর্ব পাশে ইঞ্জিনিয়ার ইন্সটিটিউটের পাশে কোনো বইয়ের স্টল বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। গত দুটি মেলায় সেই স্থানে যেসব প্রকাশকরা স্টল বরাদ্দ পেয়েছিলেন তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
৯. প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে।
১০. সব প্রকাশনার জন্য একটি নির্দিষ্ট সাইজের (১৬ ফুট বাই ৮ ফুট) স্টল বরাদ্দ করতে হবে।
১১. বইমেলায় প্রবেশ ও বাহির এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে টিএসসির গেট ও বাংলা একাডেমির গেটটিকে প্রাধান্য দিয়ে মেলার লে আউট করতে হবে।
১২. বইমেলা চলাকালীন ঢাকা মহানগরীসহ ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে বিআরটিসির বাস সার্ভিস চালু করতে হবে।
১৩. স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বই এবং সাহিত্য নিয়ে উৎসাহমূলক নানাবিধ আয়োজন করতে হবে।
১৪. শিশুদের জন্য মেলার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বতন্ত্র আঙিনা বরাদ্দ করতে হবে এবং তা যথাযথভাবে যথেষ্ট জায়গা নিয়ে শিশুদের উপযোগী করে সুশৃঙ্খল ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে হবে।
১৫. লিটল ম্যাগের জন্য স্বতন্ত্র জায়গা বরাদ্দ রেখে লিটল ম্যাগ সম্পাদকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে।
১৬. বইমেলায় খাবারের দোকান নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সেই এলাকার বাইরে অন্য কোথাও খাবারের দোকান বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।
এসজি