সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অনন্য রেলের মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশল ক্যাডারের যান্ত্রিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে নিজের ব্যতিক্রমী এক ইমেজ গড়ে তুলেছেন তিনি।
সংস্কৃতিঙ্গানে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার তিনি। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন পেশাগত ক্ষেত্রেও। সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী কাজের জন্য কর্মক্ষেত্রেও তিনি সমান সমাদৃত।
‘আমার দিকে তাকিয়ে দেখো তো/ আমাকে যায় কি চেনা/ একাত্তরে যুদ্ধ করেছি/ আমি যে মুক্তিসেনা’, ‘জোছনার জলে গা ভিজিয়েছি/ খুলেছি এলোকেশ,/ রুপালি চাঁদের সাথে মিতালি হয়েছে বেশ’, ‘তুমি ইতিহাসজুড়ে সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়ক এই বাংলার’— এমন শতাধিক গান লিখেছেন তিনি। এসব গানে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, আবেগ, এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথাও। আর এগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন বরেণ্য সব শিল্পীরা।
সম্প্রতি এক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী তুলে ধরেন তার জীবনের নানা তথ্য। জানান, তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে অনেকটা সাদামাটাভাবেই। তবে নব্বইয়ের দশকে তারুণ্যে পৌঁছে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এরপর আর থেমে থাকেননি।
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী বলেন, আমাদের সময়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অবসর কাটত বই পড়ে, সেটা কবিতা হোক বা উপন্যাস। আমিও প্রচুর বই পড়তাম। তবে লেখালেখির অভ্যাস ছিল না। ওই সময়ে পড়া উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল বিমল মিত্রের উপন্যাস ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’। ওই উপন্যাসে একজন রেলওয়েকর্মী দীপংকর নামের চরিত্রটি আমাকে সাংঘাতিক নাড়া দেয়। বলতে পারেন, ওই চরিত্রটি আমাকে মানবিক ও সৎ হতে শেখায়।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম কবিতা লেখেন মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। কবিতার নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা’। এরপর আরও কিছু কবিতা লিখেছেন তিনি। তবে রেলওয়ের এই প্রকৌশলী জানান, লেখালেখির জগতে তার মূল যাত্রার শুরুটা ২০০৭ সালে। ওই সময় রাজশাহী রেলওয়েতে অতিরিক্ত প্রধান যন্ত্রপ্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন তিনি। কাজের ব্যস্ততা কম থাকায় অফিসের বাইরে বেশিরভাগ সময় কাটাতেন পদ্মার তীরে। সেই পদ্মা নদীর বিচিত্র রূপই তার লেখালেখির অনুপ্রেরণা হয়ে ধরা দেয়।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত লিখেছেন কবিতা, গান। দেশপ্রেম-মুক্তিযুদ্ধের মতো বিষয়ে লেখা তার কবিতা-গানগুলো পড়েছেন-শুনেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও। তারা ভীষণ আপ্লুত হয়ে পড়তেন। এভাবেই একে একে তার লেখা গানের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় শ’য়ের কোটা।
মঞ্জুর-উল-আলমের লেখা গানে সুর দিয়েছেন দেশের প্রখ্যাত সুরকাররা। দেশবরেণ্য শিল্পীরা কণ্ঠে তুলেছেন তার লেখা অনেক গান। আব্দুল জব্বার, সৈয়দ আব্দুল হাদী, রফিকুল আলম, ফাহমিদা নবী, শাম্মী আক্তার, শাকিলা জাফর, ফকির আলমগীর তো বটেই, পশ্চিমবাংলার জোজো, অমিত গাঙ্গুলিও তার লেখা গান গেয়েছেন। দুইটি অ্যালবামও বেরিয়েছে।
বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন তালিকাভুক্ত গীতিকার মঞ্জুর-উল-আলম। তার লেখা গান নিয়মিতই প্রচার হয় রাষ্ট্রায়ত্ত এই দুই প্রতিষ্ঠানে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ মুজিববর্ষ উপলক্ষে ‘মহানায়ক’ শিরোনামে একটি গান লেখেন রেলওয়ের এই প্রকৌশলী। রাজেশ ঘোষের সুরে গানটিতে কণ্ঠ দেন ওয়ারফেজ ব্যান্ডের সাবেক ভোকালিস্ট মিজান। মেলো ও রক ধাঁচের গানটি গত বছর ডিসেম্বরে ইউটিউবসহ ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তি পায় জি-সিরিজের ব্যানারে। জাতির পিতার জীবনকে অত্যন্ত আবেগ দিয়ে তুলে আনা এই গানটি জনপ্রিয়তা পায় শ্রোতা ও সমালোচকদের কাছে। এই গানের জন্য শমরেস বসু সাহিত্য পুরস্কার, রফিকুল হক দাদুভাই স্মৃতিপদকসহ বেশকিছু পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।
মহানায়ক গানটি নিয়ে তিনি বলেন, জাতির জনকের ঋণ কারও পক্ষে শোধ করা সম্ভব না। কিন্তু তার প্রতি যে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা রয়েছে, সেটিই আমি এই গানটিতে প্রকাশ করতে চেয়েছি। সেটি হয়তো পেরেছি বলেই গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ এক অন্যরকম ভালোলাগার বিষয় আমার জন্য।
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী বলেন, লেখালেখি করি নিয়মিত। কলাম লিখি। কর্মজীবন শেষ করে যখন অবসরে যাব, এগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকায় তখন নিশ্চয় কাজের অভাব বুঝতে পারব না।
শুধু সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা নয় এর বাইরেও একজন সৎ, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। ১০ম বিসিএসে রেলওয়ের দুইটি ক্যাডারে কর্মরতদের মধ্যে পিএসসির মেধাতালিকায় প্রথম ছিলেন তিনি। তার পরিকল্পনাতেই প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর’, যা গত ২৭ মে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্তমানে রেলওয়ে তাদের সেবা বহুমুখী করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি স্কয়ার হাসপাতালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করতে যাচ্ছে ইমারজেন্সি হসপিটাল কাম অ্যাম্বুলেন্স। এই কাজের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। তিনি বললেন, এরই মধ্যে পাহাড়তলি কারখানায় একটি এয়ারব্রেক সম্বলিত কোচ নির্ধারণ করে মোডিফিকেশন কার্যক্রম চলছে। শিগগিরই এই রেল অ্যাম্বুলেন্সও সেবা দিতে শুরু করবে।
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর আরেকটি ব্যতিক্রমধর্মী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় শহিদ হওয়া শ্রমিকদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ। সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়ে ২০১৩ সালে রেলের অকেজো যন্ত্রাংশ ও মালামাল দিয়ে নির্মাণ করা হয় ‘অদম্য স্বাধীনতা’ নামের এই স্মৃতিসৌধ। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাশ্রম ও নিজেদের অর্থ দিয়েই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, কাজটি অনেক কঠিন ছিল। ওখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা জীবিত, তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত ইতিহাস তুলে আনার চেষ্টা করেছি। স্মৃতিসৌধে সে ইতিহাস খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যেন ভবিষ্যতে কেউ ইতিহাস বিকৃত না করতে পারে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সক্ষমতা বাড়াতে নিজস্ব পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার মূল দায়িত্ব পালন করছেন মঞ্জুর-উল-আলম। তিনি জানান, ভারতীয় রেলের রাইটস (RITES- Rail India Technical and Economic Services) এবং বাংলাদেশের আইআইএফসি’র (IIFC) গঠন ও কার্যাবলি পর্যালোচনা করে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মূলত রেলের উন্নয়ন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যেই এ উদ্যোগ।
নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করে রেলকে আধুনিক করার চিন্তা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে পোড়া লোকমোটিভ ও ডেমু পুনর্বাসন, দেশেই রেল ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ তৈরির উদ্যোগও তার হাত দিয়েই নেওয়া। নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, বাধাও রয়েছে। সবকিছু অতিক্রম করেই এসব কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
নানামুখী প্রতিভার রেলের এই কর্মকর্তা কর্মস্থলে অবদান রাখার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যেও বিশেষ অবদান রেখে যেতে চান।
আরএ/