বাজেটে সংস্কৃতিখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের
আসন্ন জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতিখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। বুধবার (১১ মে) সকাল ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে এই দাবি জানানো হয়।
সংস্কৃতিকে জাতির মনন বিকাশের সোপান বিবেচনা করে এই নূন্যতম এই বরাদ্দ চায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। জোটের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. আহকাম উল্লাহর সঞ্চালনায় লিখিত বক্তব্য প্রদান করেন জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। আরও বক্তব্য দেন জোট সহ-সভাপতি, জাতীয় কবিতা পরিষদ সভাপতি কবি ড. মুহাম্মদ সামাদ।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশের সংস্কৃতির উন্নয়নে ৮ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে -
১. জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১% সংস্কৃতিখাতে বরাদ্দ করতে হবে।
ক.
১) প্রত্যেক উপজেলায় ৫০০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন নির্মাণ। এর সাথে থাকবে মহড়া, প্রশিক্ষণের সুবিধা সম্বলিত কয়েকটি কক্ষ। উপজেলা সদরে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ একই সাথে নির্মাণ করতে হবে। একটি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে প্রতি বছর অন্তত ১০০টি উপজেলায় এ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে দেশের সবকয়টি উপজেলায় সংস্কৃতি চর্চার নেটওয়ার্ক তৈরি হবে।
২) বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ স্মরণে রেখে প্রত্যেক জেলায় ‘বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ স্মৃতিভবন’ নির্মাণ। এই ভবনে ৭০০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন, মহড়া ও কর্মশালার কক্ষ, সেমিনার হল, পাঠাগার, ক্যান্টিন ও ৫ থেকে ১০ জন থাকার মতো কক্ষের ব্যবস্থা করতে হবে। ভবনটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি রক্ষার পাশাপাশি ঐ জেলার শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মিলনকেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠবে। যত দ্রুত সম্ভব এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩) ঢাকা মহানগরীসহ অন্যান্য মহানগরীর বিস্তীর্ণ এলাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন কোনো মিলনায়তন নেই। আমাদের দাবি মহানগরীগুলোতে প্রতি ৫ লক্ষ নাগরিকের জন্য একটি করে আধুনিক মিলনায়তন নির্মাণ করা অত্যাবশ্যক।
৪) স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমাদের দেশে সরকারি উদ্যোগে একটি যাত্রা প্যান্ডেলও নির্মিত হয়নি। রাজধানীসহ প্রত্যেক জেলায় একটি করে স্থায়ী যাত্রা প্যান্ডেল নির্মিত হলে যাত্রার প্রসারের পাশাপাশি অশ্লীলতার প্রবণতা থেকেও মুক্ত হওয়া যাবে।
৫) প্রত্যেক জেলায় চারুকলা প্রদর্শনীর জন্য আর্ট গ্যালারি এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর জন্য মিনি অডিটরিয়াম নির্মাণ করতে হবে।
খ.
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে প্রকৃত শিল্পীরা পুরোটা জীবন সংস্কৃতি চর্চায় নিজেদের নিবেদন করে আসছেন। বয়সকালে এসব শিল্পীদের অসচ্ছল বিবেচনায় যে ভাতা প্রদান করা হয় তা এতই নগণ্য যে, একেবারে নিরুপায় না হলে কেউ আবেদনই করেন না। ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় চার হাজার ১১৬ জন শিল্পীকে মোট ছয় কোটি ৭২ লক্ষ ৬২ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করে। এরমধ্যে অধিকাংশ শিল্পীর অনুদানই মাসিক এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। জাতীয় পর্যায়ের কয়েকজন শিল্পী সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা পেয়ে থাকেন।
আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, অসচ্ছল শিল্পীদের মাসিক অনুদানের পরিমাণ বাস্তবতার নিরিখে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হোক। এক্ষেত্রে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হলে আরও অধিক সংখ্যক শিল্পীকে অনুদানের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে।
গ.
১) ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সারাদেশের ১৪৫০টি সাংস্কৃতিক সংগঠনকে মোট ৭ কোটি ৪ লাখ টাকা অনুদান প্রদান করা হয়। সংগঠনগুলোকে দেয়া অনুদানের আর্থিক পরিমাণ ৩০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা করে। ক্রিয়াশীল প্রতিটি সংগঠনের বার্ষিক ব্যয় প্রতিবছর কয়েক লক্ষ টাকা। আমরা মনে করি অনুদান প্রদানের সর্বনিম্ন পরিমাণ হওয়া উচিত সংগঠন প্রতি অন্তত এক লাখ টাকা। সারাদেশে আনুমানিক দশ হাজারেরও বেশি সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। যাচাই-বাছাই করে অন্তত পাঁচ হাজার সংগঠনকে অনুদানের আওতায় আনা হোক।
২) জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক ফেডারেশনসমূহের সারা বছরের কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও জাতীয় পর্যায়ে অবাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎসব আয়োজনকারী মূলধারার সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজন অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা প্রদান। আমাদের প্রত্যাশা উপরোক্ত দুই খাতে অন্তত ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হোক।
ঘ.
১) দেশের বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় যতটা সম্ভব ‘সম্প্রীতির জন্য সংস্কৃতি’- মূল প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তুলতে হবে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক ফেডারেশনসমূহকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে বিশেষ আর্থিক বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য এ খাতে চলতি অর্থবছরে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদানের দাবি জানাই।
২. উপজেলা পর্যায়ে অবিলম্বে একজন করে শিল্পকলা অফিসার নিয়োগ প্রদান অত্যাবশ্যক। সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিল্পীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি ও চারুকলার স্থায়ী প্রশিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
৩. বেতার-টেলিভিশনসহ সরকারি সব প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠানে শিল্পী, যন্ত্রী ও কারিগরী কর্মীদের যুগোপযোগী আর্থিক সম্মানী প্রদান করা বাঞ্চনীয়।
৪. সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক ফেডারেশনসমূহের স্থায়ী দপ্তর নির্মাণের জন্য মতিঝিলের ক্রীড়া পল্লীর অনুরূপ জায়গা বরাদ্দ প্রদান করতে হবে।
৫. বহুমুখী শিক্ষার পরিবর্তে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু অত্যাবশ্যক। মুক্তিযুদ্ধ ও মানবসভ্যতার ইতিহাস, অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক চিন্তা সম্বলিত লেখা পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষা কার্যক্রমে সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রতি বছর সাংস্কৃতিক উৎসব ও প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. সরকারের বড়ো বড়ো সাংস্কৃতিক আয়োজনে জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক ফেডারেশনসমূহকে সংযুক্ত করে শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাই বাঞ্চনীয়। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উৎসব বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান নীতি-আদর্শ এবং সৃজনশীলতার চেয়ে বাণিজ্যকেই প্রধান করে দেখে। লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্যে লালিত শিল্পী এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনকে এড়িয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন মূলধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে নিঃসন্দেহে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বর্তমান সরকারের আমলে এ ধরনের কার্যক্রম কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
৭. জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনার সাথে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহকে যুক্ত করতে হবে। আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্বমুক্ত সংস্কৃতিচর্চা ও আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে।
৮. সংস্কৃতিকর্মীদের আবাসনের জন্য “সংস্কৃতিপল্লী” নির্মাণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আহাম্মেদ গিয়াস, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আক্তারুজ্জামান, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রেজীনা ওয়ালী লীনা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজহারুল হক আজাদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান, দপ্তর সম্পাদক শিরিন ইসলাম, শহিদুল ইসলাম নাজু, সিদ্দিকুর রহমান পারভেজ, মাসরুক টিটু। বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ফকির সিরাজুল ইসলাম, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আরিফ রহমান, নির্বাহী সদস্য স্বপন চৌধুরী, নির্বাহী সদস্য তারেক আলী মিলন, দনিয়া সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি শাহনেওয়াজ, আদি ঢাকা সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হানিফ খান। সঙ্গীতশিল্পী সাইফুল ইসলাম, সঙ্গীতশিল্পী সালাহউদ্দিন সোহাগ, সঙ্গীতশিল্পী রেজা হোসেন, সঙ্গীতশিল্পী আমিনুর রহমান চৌধুরী বখতিয়ার, নাট্যশিল্পী খন্দকার আতিক, নাট্যশিল্পী শাকিল আহমেদ।
এসএ/