কারা পেলেন স্বাধীনতা পুরস্কার?
স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২২ পেয়েছেন ১০ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান। ১০ ব্যক্তির মধ্যে ছয় জনকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য। চিকিৎসাবিদ্যায় অবদানের জন্য পেয়েছেন দুই জন। সাহিত্য ও স্থাপত্য ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন একজন করে। আর গবেষণা ও প্রশিক্ষণে পদক পেয়েছে একটি প্রতিষ্ঠান।
সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকায় শুধুমাত্র নাম প্রকাশ করা হয়েছে। পরিচয় কিংবা অবদানের কোনো উল্লেখ নেই। এ কারণে পুরস্কারপ্রাপ্তদের সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে পুরস্কারপ্রাপ্তদের একজন হচ্ছেন আব্দুল জলিল। অনেককেই ধরে নিয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু তিনি এ পুরস্কার পাননি। এ ছাড়াও সাহিত্য ক্যাটাগরির পুরস্কার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক কৌতুহল। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাপ্রকাশ পুরস্কারপ্রাপ্তদের পরিচয় সংগ্রহ করেছে।
এবারের পুরস্কারপ্রাপ্ত ১০ জনের মধ্যে মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ৬ জনকে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের পদক পাওয়া ছয় জনের মধ্যে দুই জন হচ্ছে সরকারের এক মন্ত্রী ও এক প্রতিমন্ত্রীর বাবা। পুরস্কার পাওয়া দুই জনের সন্তান বর্তমানে জাতীয় সংসদ সদস্য। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে দুই জন রয়েছেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সরাসরি প্রতিবাদকারী।
পুরস্কারপ্রাপ্তদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো।
ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তিনি ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগঠক ছিলেন। একই সঙ্গে মুজিব বাহিনীর কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
দাদাভাই নামে পরিচিত চৌধুরী গণপরিষদের প্রাক্তন সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদে ফরিদপুর-১৩ (বিলুপ্ত) আসন থেকে ও ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদে মাদারীপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের ১৯ মে মারা যান।
তার দুই ছেলে বর্তমানে সংসদ সদস্য। এরমধ্যে বড় ছেলে মাদারীপুর-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য নূর ই আলম চৌধুরী জাতীয় সংসদের প্রধান হুইপ। ছোট ছেলে মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য।
শহীদ খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম
ফরিদপুরের নগরকান্দার বাসিন্দা নাজমুল হুদা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন । ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা অভিযুক্ত হিসেবে আরও অনেকের সঙ্গে আটক হন। তিনি ছিলেন ২৭ নম্বর আসামি। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেকসুর খালাস পান। কিন্তু চাকরিচ্যুত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭২ সালে খন্দকার নাজমুল হুদা মেজর হিসেবে কাজ করতেন। তিনি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নভেম্বরের অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে তিনি খালেদ মোশাররফ ও এ টি এম হায়দারের সঙ্গে নিহত হন। তার মেয়ে নাহিদ ইজাহার খান বর্তমানে সংসদ সদস্য। সংরক্ষিত নারী আসন থেকে তিনি আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
আব্দুল জলিল
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট। জন্মসূত্রে নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার মানুষ। ১৯৩৫ সালে জন্ম নেওয়া জলিল আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ও মুক্তিযোদ্ধা। ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার ২৯নম্বর অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার হন ও চরম কারানির্যাতন ভোগ করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে গ্রেফতার হন তিনি ও করাচীর বিমানবাহিনীর পুলিশ সেলে সপ্তাহখানেক আটক থাকেন। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন থেকে ৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বন্দী ছিলেন।
সিরাজ উদদীন আহমেদ
সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য এবারের স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন।
১৯৪১ সালে বরিশালের বাবুগঞ্জে জন্ম নেওয়া সিরাজ উদদীন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বরগুনা জেলা সংগ্রাম কমিটির সমন্বয়কারী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ছিলেন বরগুনা মহকুমার এসডিও। ওই সময় ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তিনি প্রতিবাদ করেন ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা।
মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাস
মেহেরপুর জেলার বাসিন্দা। রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য ছিলেন।
১৯২৩ সালে জন্ম নেওয়া ছহিউদ্দিন মেহেরপুর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি মেহেরপুর পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয়দফা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন।
তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৫ সালে বাকশাল সরকারে মেহেরপুরের গভর্নর ছিলেন। ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তার ছেলে ফরহাদ হোসেন বর্তমান সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও মেহেরপুর-১ আসন সংসদ সদস্য।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০২২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।
সিরাজুল হক
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য এবারের স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন সিরাজুল হক।
ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন আইনজীবী। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও রাজনীতিবিদ। তিনি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য ও স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন।
১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া সিরাজুল হক কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহপাঠী ছিলেন।
সিরাজুল হক ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলা, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম প্রধান কৌশলী ছিলেন এই আইনজীবী। তিনি সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
১৯৭২ সালে কামাল হোসেনকে সভাপতি করে গঠিত সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।
তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সরাসরি প্রতিবাদকারী। ১৯৭৫ সালে তিনি এমপি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাদখলকারী প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ তৎকালীন এমপিদের সভা আহবান করলে সেখানে সিরাজুল হক প্রতিবাদ করেন।
তিনি বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিতা।
অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া
পেশায় একজন স্নায়ুশল্যচিকিৎসক এবং অধ্যাপক। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর ১০ম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
চিকিৎসাবিদ্যায় বিশেষ অবদানের জন্য ডা. কনক কান্তি ২০২২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন।
ডা. কামরুল ইসলাম
তিনি একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক। ২০০৭ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ করেন। এক হাজারেরও বেশি কিডনি বিকল রোগীর দেহে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০১১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য ডা. কামরুল এবারের স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন।
মো. আমির হামজা
তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মাগুরা জেলার শ্রীপুরে গড়ে উঠা শ্রীপুর বাহিনীর একজন অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন। তিনি এবার সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন।
সাহিত্যে তার পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে বিতর্ক চলছে।
স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন
বাংলাদেশের প্রখ্যাত স্থপতি। তিনি সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের স্থপতি। স্থাপত্যে অবদানের জন্য তাকে ২০২২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবারের স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট।
স্বাধীনতা পুরস্কার কমিটিতে কারা?
স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকসহ বিভিন্ন জাতীয় পদক বা পুরস্কার দেওয়ার জন্য সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ‘জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র সভাপতি হচ্ছেন মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ.ক.ম.মোজাম্মেল হক।
তার নেতৃত্বে এই কমিটিতে রয়েছেন মন্ত্রিসভার ১৩ জন সদস্য। এছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ১৩ সচিব।
‘স্বাধীনতা পুরস্কার সংক্রান্ত নির্দেশাবলী’র আলোকে বিভিন্ন পর্যায়ে থেকে পাওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে ‘জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’ স্বাধীনতা পুরস্কার চূড়ান্ত করে থাকে। জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এনএইচবি/এপি/