মালদ্বীপ থেকে ফিরে : পর্ব-১
সাগরের বুকে সুউচ্চ অট্টালিকা, গড়ে উঠেছে নতুন শহর
সুরম্য সব অট্টালিকা। রং-বেরং এর সব ভবন। প্রত্যেকটির উচ্চতা ২৫ তলা। সাগরের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। তার পাশে আরও অট্টালিকা গড়ে উঠছে। তবে কাজের গতি কিছুটা ধীর। মালদ্বীপের হুলহুমালে শহরের যে দিকটায় বহুতল ভবনগুলো গড়ে উঠছে সেখানটায় মূলত একেবারেই একটি নতুন শহর গড়ে তোলা হচ্ছে।
ভাবতেই অবাক লাগে, একেবারে ভারত সাগরের বুক ভরাট করা জমিতে নতুন এই শহর গড়ে তোলা হচ্ছে। নতুন গড়ে তোলা এই শহরের ভবনগুলোর আশপাশ আবার ঘন সবুজে ঘেরা। হুলহুমালে থেকে চারটি দৃষ্টি নন্দন সেতু দিয়ে নতুন শহরে প্রবেশ করা যাবে। আর এই নতুন শহরের নাম হচ্ছে ‘‘ইয়ুথ সিটি।’’
এই নতুন সিটি জানান দিচ্ছে মালদ্বীপ ক্রমেই সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। হুলহুমালে শহরের একটি রেস্তোরায় রাতের খাবার শেষ করে আমরা চার জন হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি শহরটির শেষ প্রান্তে। সেখানে গিয়েই দেখা মিলল একটি দৃষ্টি নন্দন সেতুর। সেতুর উপর দাঁড়িয়ে গল্প করার ফাঁকে সঙ্গে থাকা নাজমুল, শহীদুল ও সজীব জানালেন, এখানেই হুলহুমালে শহর শেষ। সেতুর ওই পাড়টা হচ্ছে ইয়ুথ সিটি।
মালে শহরে প্রায় দুই দশক ধরে বসবাসকারি বাংলাদেশী সজীব ও শহীদুল জানালেন, নতুন শহরটি গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। এই শহরের আয়তন কমপক্ষে পাঁচ কিলোমিটার। আব্দুল্লাহ ইয়ামিন সরকারের আমলে সাগর ভরাট করে নতুন এই শহর গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়।
মূলত মালদ্বীপের স্থানীয় জনগণের বসবাসের জন্য হুলহুমালে শহরের আরেক প্রান্তে নতুন গড়ে তোলা ইয়ুথ সিটিতে আবাসিক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। এর পাশাপাশি একটি আধূনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে এই সিটিতে।
যা যা থাকবে ইয়ুথ সিটিতে
নতুন এই শহরের উন্নয়ন কর্মকান্ডাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমভাগে বা ফেইজ ওয়ানে থাকবে অ্যাকুয়াটিক সেন্টার বা জলজ কেন্দ্র। ইয়ুথ পার্ক। ওয়াটার থিম পার্ক। মিউজিক এন্ড আর্ট ইনস্টিটিউট। ফুটবল স্টেডিয়াম এবং স্পোর্টস এরিনা বা ক্রীড়া রঙ্গভূমি।
দ্বিতীয়ভাগে বা ফেইজে থাকবে অত্যাধুনিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। আধুনিক এন্টারটেইনমেন্ট ডেকে। ইনডোর স্পোর্টস কমপেলক্স। ইয়ুথ ফোকাস রেসিডেনসিয়াল ডেভলপমেন্ট। দি টেকনোপোলিস এন্ড নলেজ পার্ক এবং ওয়াটার স্পোর্টস এরিয়া।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে মালদ্বীপের গত সরকারের মেয়াদে স্বল্প সময়ের মধ্যে সাগরের জেগে ওঠা চরকে ভরাট করে দ্রুততম সময়ে ইয়ুথ সিটিকে প্রস্তুত করা। ইতিমধ্যে এই শহরে ১৪/১৫টি বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেছে। কাজ চলছে আরও শতাধিক ভবনের। মালদ্বীপের গত সরকারের সদিচ্ছার কারণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শহরটি গড়ে তোলা হয়েছে। দেশি বিদেশি হাজার হাজার শ্রমিক দিন রাত কাজ করে নতুন শহরটি গড়ে তুলেন।
স্থানীয়রা জানান, মালদ্বীপের গত সরকারের আামলে চীনের সঙ্গে তাদের সদ্ব্যভাব ছিল। তাই চীনের সহযোগিতায় দ্রুততম সময়ে কাজটি করতে সক্ষম হয় ইয়ামিনের সরকার।
তবে গত দুই বছর ধরে কাজের গতি কিছুটা কমে গেছে। ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ’র নেতৃত্বাধীন এমডিপি সরকারের আমলে এসে ইয়ুথ সিটিতে উন্নয়ন কাজের গতি কমে গেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো। বিপরীতে চীনের সঙ্গে তাদের বেশ দূরত্ব রয়েছে। এ কারণেই মূলত উন্নয়ন কাজের গতি কমেছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এমনকি সেদেশে বসবাসরত বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও একই মত পোষণ করেন।
৩ ডিসেম্বর রাতে হুলহুমালে শহর ছেড়ে আমরা গিয়েছিলাম নির্মাণাধীন ইয়ুথ সিটি ঘুরে দেখতে। চারটি মোটর সাইকেলে মাত্র পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে পুরো ইয়ুথ সিটির একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে বেড়িয়েছি। সাগর ভরাট করে কিভাবে একটি পরিকল্পিত আধূনিক শহর গড়ে তুলছে মালদ্বীপ তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। ইয়ুথ সিটির প্রবেশ পথের প্রথম সেতুতে দাঁড়ালেই দেখা সিটিকে রক্ষা করতে কিভাবে ভারত সাগরকে শাসন করা হয়েছে। এই শাসনের মধ্যেও রয়েছে চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য্য।
প্রায় দুই দশক ধরে মালে শহরে বসবাসকারি বাংলাদেশী সজিব বলছিলেন, আমাদের চোখের সামনে ইয়ামিন সরকারের আমলে এই শহর গড়ে উঠেছে গত পাঁচ-ছয় বছরে। কিন্তু ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের পর গত দুই তিন বছর ধরে ইয়ুথ সিটির কাজ সেইভাবে চলছে না। তবে মালদ্বীপবাসীরা মনে করেন, ইয়ামিনের সরকার আবার ক্ষমতায় আসলে এই আধুনিক সিটির কাজ দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হবে।
নীল সাগরের বুকে এমন একটা আধুনিক সিটি দেখে বারবার মনে হচ্ছিল আমাদের সরকার দেশকে আধুনিক ও বসবাসযোগ্য করতে কত না পরিকল্পনা করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এই যেমন প্রতিটি গ্রাম হবে শহর। স্যাটেলাইট সিটি হবে রাজধানীর চারপাশে। কিন্তু সেগুলো দৃশ্যমান হতে কত সময় লাগে কে জানে।
তবে মালদ্বীপ কিভাবে স্বল্প সময়ে একটা নতুন শহর ও আধুনিক শহর গড়ে তুলল সেটা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।