অলৌকিক গল্প ও ঐতিহ্যের স্মারক ‘বিবিচিনি শাহী মসজিদ’
মোগল আমলের অন্যতম পুরাকীর্তি বিবিচিনি শাহী মসজিদ। উপকূলীয় জেলা বরগুনার বেতাগী উপজেলা থেকে মহাসড়ক ধরে উত্তর দিকে ১০ কিলোমিটার গেলেই বিবিচিনি গ্রাম। সেখানেই সবুজের সমারোহের মধ্যে উঁচু এক টিলার ওপর মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি।
কথিত আছে এই মসজিদকে ঘিরে উপকূলীয় বাংলায় ইসলাম প্রচার শুরু হয়। প্রায় ৩৫০ বছরের পুরানো এই স্থাপনা আকারে বড় না হলেও স্থাপত্য শৈলীতে বেশ রাজসিক হওয়ায় মসজিদটি দেখে মুগ্ধ হন সবাই। তাই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে ছুটে আসেন পর্যটকরা। এই মসজিদ ঘিরে রয়েছে অনেক অলৌকিক গল্পও।
ইতিহাস ও স্থানীয়দের মুখে এমন গল্প থেকে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের আমলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নামের এক সাধক পারস্য থেকে দিল্লি আসেন। ওই সময় শাহজাহানের দ্বিতীয় ছেলে বাংলার সুবাদার শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে ইসলাম প্রচারে শাহ নেয়ামতুল্লাহ তার শিষ্যসহ বজরায় চড়ে গঙ্গা অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে নোঙর করেন। তখন শাহ সুজার অনুরোধে গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ করা হয়। পরে নেয়ামতুল্লাহর কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে গ্রামের নাম রাখা হয় বিবিচিনি এবং মসজিদটির নামও সেখান থেকেই নেওয়া। এ ছাড়াও শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামের সঙ্গে মিল রেখে বিবিচিনি গ্রামের পাশের গ্রামের নাম রাখা হয় নেয়ামতি।
আরও জানা যায়, বিষখালী নদীর পানি লবণাক্ত থাকায় সুপেয় পানির অভাবে এই এলাকার মানুষেরা অনেক কষ্টে ছিল। শাহ নেয়ামতুল্লাহ কষ্ট অনুভব করেন এবং তার তসবিহটি বিষখালী নদীতে ধুয়ে দেন। অলৌকিকভাবে এতে এখানকার পানি সুপেয় হয়ে যায়। আজও সেই পানি তেমনই রয়েছে।
তা ছাড়াও ওই সময় সুন্দরবন সংলগ্ন বিষখালীতে কুমিরের ভয়ংকর আনাগোনা ছিল। কিন্তু শাহ নেয়ামতুল্লাহ আসার পর থেকে নাকি বিবিচিনির ধারে কাছেও কোনো কুমির আসত না।
মুঘল আমলের মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট। দেয়ালগুলো ৬ ফুট চওড়া। দক্ষিণ ও উত্তর দিকে ৩টি দরজা আছে। জাফরি ইট দিয়ে তৈরি মসজিদটি সমতল থেকে কমপক্ষে ৩০ ফুট উঁচু টিলার উপর। যার উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। দর্শনার্থী ও মুসুল্লিদের জন্য পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। পূর্ব পাশের সিঁড়িটি ২৫ ধাপের, উচ্চতা ৪৬ ফুট এবং দক্ষিণ পাশের সিঁড়িটি ২১ ধাপের, উচ্চতা ৪৮ ফুট।
মসজিদের কাছেই ৩টি পুরানো দিঘি ছিল। এসব দিঘি নিয়েও বেশ জনশ্রুতি আছে। বড় দিঘীটির নাম ইছাবিবির দিঘী। বর্তমানে দিঘীগুলোর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এ ছাড়াও মসজিদের পাশে ৩টি কবর আছে। লম্বায় একেকটি ১৪ থেকে ১৫ হাত। পশ্চিম ও উত্তর পাশের কবরে শায়িত সাধক নেয়ামতউল্লাহ এবং চিনিবিবি ও ইছাবিবি।
বিবিচিনি শাহী মসজিদের দায়িত্বরত মুয়াজ্জিন আবু হানিফ বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই মসজিদটি দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা। তবে শুক্রবার এই আগমন বেশি থাকে।
মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল মান্নান বলেন, বিভিন্ন প্রান্তের অগণিত নারী-পুরুষ এখানে এসে নামাজ আদায় করেন। টাকা-পয়সাও দান করেন। জুমার নামাজেও অনেক মুসুল্লি আসেন।
এদিকে ঐতিহ্যের সাক্ষী এই স্থাপনার কিছু কিছু অংশের দেয়ালের পলেস্তারা খসে গেলে ১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে তা মেরামত করা হয়। ১৯৯২ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটির রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের দায়িত্ব নেয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। বর্তমানে এটির সিঁড়ির কিছু অংশ ভেঙে গেছে। দ্রুত তা সংস্কারের দাবি স্থানীয়দের।
এ ব্যাপারে বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুহৃদ সালেহীন বলেন, বিবিচিনি শাহী মসজিদটি সংস্কারের জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন সময় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারি স্থাপনা হিসেবে মসজিদে প্রশাসনের বিশেষ নজর রয়েছে।
এসআইএইচ