হিমালয়ের ‘মায়ের গলার হার’ জয় করেছেন ‘বাবর আলী’
বাংলাদেশের অসাধারণ পবর্তারোহী বাবর আলীকে অনেকে চেনেন। কত কীর্তি তার। এবার জয় করেছেন নেপালের হিমালয়ের ২২ হাজার ৩শ ৯৪ ফিট উঁচু ‘আমা দাব্লাম’। নেপালের শেরপারা ভালোবেসে ডাকেন ‘মায়ের গলার হার’। গতকালই তার বিজয়ের খবর লিখে পাঠিয়েছেন সুমাইয়া রহমান কান্তি।
নেপালের ২২ হাজার ৩শ ৪৯ ফিট উঁচু অনিন্দ্য সুন্দর ও অন্যতম টেকনিক্যাল পর্বত হলো ‘আমা দাব্লাম’। মানে অর্থ ‘মায়ের গলার হার’। অত্যন্ত বিপদজনক খাড়া রিজ ও ঢালু দেয়ালের জন্য অনেকেই ডাকেন “হিমালয়’স মেটাল হর্ণ” বা ‘হিমালয়ের ধাতব শিং’। অত্যন্ত বিখ্যাত এই পর্বত, দারুণ। এতোই সমীহের যে, ছবি আঁকা আছে নেপালের এক রুপির ব্যাংক নোটেই।
বাংলাদেশ থেকে এর আগে কোনোদিন কোনো পর্বতারোহী আমা দাব্লাম জয় করতে পারেননি চেষ্টায়ও। সে খরা কেটেছে। পর্বতটির শিখরে পৌছেছেন বাবর আলী। ২৫ অক্টোবর, ২০২২ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি নাম, বাবর ঐতিহসিক একজন পর্বতারোহী হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নেপালের সময় সকাল ৯টা ৩ মিনিটে তিনিই প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের লাল-সবুজ পতাকাটি ওড়ালেন শিখরে।
চট্টগ্রামের এই তরুণ পর্বতারোহী পেশায় একজন চিকিৎসক। তবে পাহাড়প্রেমী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। পর্বতারোহণকে ধ্যানজ্ঞান মেনে ‘বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স’টি করেছেন ভারতের ‘নেহেরু ইন্সটিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং’-এ। ২০১৪ সালে পর্বতারোহণ ক্লাব ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’র তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এখন সাংগঠনিক সম্পাদক। সে বছর ক্লাব থেকে নেপালের হিমালয় অভিযানে গিয়েছেন। বাবর আলী সামিট করেছেন পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতার একটি বিশেষ পর্বত। এরপর থেকে হিমালয়ে তার পথচলা শুরু হলো। ‘পর্বতারোহণের বিশুদ্ধতম ধরণ’ নামে পরিচিত ‘আলপাইন স্টাইল’। এভাবে ২০১৬ সালে ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’র হয়ে সামিট করেছেন তিনি ভারতের ‘মাউন্ট ইয়ানাম’, ইংরেজিতে ‘মাউন্ট ইউনাম’। ভারতের হিমাচল প্রদেশের মানালি পর্বতমালার ২০ হাজার ফিট উঁচু পবত। আমাদের দেশ থেকে প্রথমবার আলপাইন স্টাইলে ইয়ানাম পাহাড়ের চূড়া জয় দলের অন্যতম ছিলেন বাবর। তিনি জয় করেছেন পর্বতটি। পায়ে হেঁটে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেছেন। প্রায় প্রতি বছর করেছেন এক বা একাধিক হিমালয় অভিযান। নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে বাবর নিয়মিত দৌঁড়ান। নামকরা সাইক্লিস্ট তিনি। করেছেন ‘ক্রস কান্ট্রি সাইক্লিং’। ‘কায়াকিং’ করেন।
ধারাবাহিকভাবে বাবর আলী লক্ষ্য হিসেবে স্থির করলেন, ‘মায়ের গলার হার’ জয় করবেন। আবার যাবেন হিমালয়ে। ৯ অক্টোবর অভিযানের জন্য দেশত্যাগ করলেন। ছুটতে লাগলেন নেপালের পথে। ১১ অক্টোবর প্রয়োজনীয় অনুমতি পেলেন। অন্যান্য সব প্রস্তুতিও শেষ করে ফেললেন দুুঁদে অভিযাত্রী। তবে বাধা হয়ে দাঁড়াল তাদের বৈরী আবহাওয়া। তাতে রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে লুকলার নিয়মিত বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গেল।
তবে বাবর দমলেন না। খরচ আছে। তাই ১২ অক্টোবর অসাধারণ অভিযাত্রীটি সড়কপথে যাত্রা করলেন বেসক্যাম্পে। কিছু পথ গাড়িতে, বাকিটা পথ হেঁটে-এভাবে ১৯ অক্টোবর পৌঁছে গেলেন পর্বতারোহী বাবর আলী আমা দাব্লাম, বেস ক্যাম্প-১-এ। একদিন বিশ্রাম নিলেন। পরদিন ঘুরে এলেন বেস ক্যাম্প-২। উচ্চতা, স্বল্প অক্সিজেন, তুমুল আবহাওয়া, শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যেখানে পৌঁছানোর কোনো বিকল্প নেই। আবার নেমে এলেন নিয়মানুসারে বেস ক্যাম্প-১-এ। ২৩ অক্টোবর সূর্য ওঠার সঙ্গে, সঙ্গে বাবর আলী বেস ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করলেন। আবার উঠে গেলেন খুব কষ্ট আর ভালোবাসায় ‘আমা দাব্লাম’ বেস ক্যাম্প-২। তিনি এবার শরীরকে সইয়ে নিয়েছেন। আবহাওয়াও চেনা হলো তার জীবনে। ফলে পরদিন ২৪ অক্টোবর দারুণ শক্তিতে, তুমুল শ্রমে উঠে গেলেন আমা দাব্লাম বেস ক্যাম্প-৩।
২৫ অক্টোবর ভোরে মিনিটে শুরু হলো আমাদের পর্বতারোহী, বিখ্যাত অভিযাত্রী বাবর আলীর ‘আমা দাব্লাম’ বা হিমালয়ের ‘মায়ের গলার হার’ জয়ের চূড়ান্ত অভিযান। এবার তিনি আমা দাব্লাম জয় করবেন। চূড়াটি জয়ের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা শুরু হলো বাংলাদেশী পর্বতারোহীর। নেপালের সময় সকাল ৯টা ৩ মিনিটে পর্বতটির শীর্ষে পৌঁছে গেলেন বাবর আলী।
বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় রচনা করলেন তিনি। ২৬ অক্টোবর, ২০২২ বিকালে আবার বেস ক্যাম্প-১ এ নেমে এলেন পর্বতারোহনের সাফল্য নিয়ে। তিনি সুস্থ ও পুরোপুরি ফিট। আমা দাব্লাম জয় করা পর্বতারোহী বাবর আলী কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা নিয়ে বলেছেন তার নেপালী শেরপা পর্বতারোহী বন্ধু ও গাইড ‘বীরে তামাং’র কথা। ‘তিনি না থাকলে আমি আমা দাব্লাম জয় করতে পারতাম না’ জানিয়েছেন হাসিমুখে।
‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’র সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশের হয়ে তার সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগের চেষ্টায় রত ফরহান জামান নেপাল থেকে এখনো না ফেরা বাবরের আমা দাব্লাম জয় করার ঘোষণা দিয়েছেন। বাবর আলী আমা দাব্লামের অভিজ্ঞতা এক বাক্যে বলেছেন, “নেপালের ‘হিমালয়ের মায়ের গলার হার’ সত্যিই পর্বতারোহীদের পর্বত। এই অভিযানের সব টাকা আমার দেওয়া। সব সহযোগিতা করেছে আমার ক্লাব।”
ওএফএস।