পিয়াইন নদীর নিলাভ জলের মিতালি
লেখা : মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম, প্রতিষ্ঠাতা দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ
ভ্রমণ পিয়াসী মন কয়দিন না যেতে যেতেই করে আনচান। রাত দুপুরেই ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস। সকালের মধ্যেই তুমুল সাড়া। হঠাৎ পরিকল্পনা তাই। বাস কী রেল টিকেটের স্বল্পতা। ইচ্ছে থাকতেও বাহিনী বড় করা গেল না। অতঃপর ‘দে-ছুট’ ভ্রমণ সংঘের সুপার অ্যাক্টিভদের নিয়ে রাতের বাসে সিলেটের উদ্দেশ্যে যান্ত্রিক শহর রাজধানী ছেড়ে ভেগে যাই। সাংবাদিক কে. এম. মাহ্বুব ভাই সাহায্যের হাত প্রসারিত করেন। তিনি সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক নবেল সাহেবকে অনুরোধ করেছেন, আমাদের স্বাচ্ছন্দময় বিছনাকান্দি ভ্রমণের সকল আয়োজন করতে। প্রাণবন্ত নবেল আন্তরিকতার দিক থেকে কম নন। সিলেটের পথে, কখন, কোথায়, কেমন আছি কল দিয়ে কয়েক দফা জেনে নিয়েছেন। ফোনে জানিয়ে দিয়েছেন, যিনি আমাদের রিসিভ করবেন সেই ভদ্র মহাশয়ের নামও।
সকালে গিয়ে পৌঁছাই লন্ডনি শহরের হুমায়ুন চত্বর। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসেন গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রেসক্লাবের সম্মানিত সভাপতি আবদুল মতিন সাহেব। একগাল হেসে পরিচয় পর্ব শেষে ছুটি তার সঙ্গে। সিএনজি তার ধারণ ক্ষমতার চাইতে একজন বেশি নিয়ে চলছে ভোঁ ভোঁ শব্দে।
সালুটিকর বাজারে এসে নাস্তার জন্য খানিকটা বিরতি। গাড়িতে আমাদের বসার কষ্ট অনুভব করতে পেরে কৌশলে মতিন ভাই সালুটিকর হতে বিদায় নিলেন। তবে দিয়ে গেলেন একজন দক্ষ, ভদ্র সিএনজি চালক।
বিছনাকান্দি যেতে, যেতে সরু রাস্তার দু-পাশের গগনচুম্বী বৃক্ষ, ছায়াঘেরা নিরিবিলি পরিবেশ, বিস্তৃত ফসলের মাঠ পেরিয়ে করে সিএনজি ছুটে চলছে। উচ্ছ্বসিত এক সঙ্গী পথের প্রেমে পড়ে পুরোই ভ্রমণপাগলদের চিত্তবিনোদনে স্পাইডার ম্যান হয়ে গেল।
বিছানাকান্দির পথ যেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’র প্রতিফলন। দামাল ‘দে-ছুট’ ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা যাচ্ছি। থামছি। চলছে ক্যামেরার অসংখ্য ক্লিক। ক্লিক, ক্লিক শব্দকে হারমোনিয়ামের বাজনা মনে করে পঞ্চাশটি বসন্ত পার করে আসা স্বপন ভাই ভরাট কন্ঠে গান ধরলেন, ‘পিচ ঠালা এই পথটারে ভালবেসেছি, তার সাথে এই মনটারে বেঁধে নিয়েছি’। এরপর তিনি পুরোনো দিনের, হারিয়ে যাওয়া অনেক গান গাইতে থাকলেন। আমরা তন্ময় শ্রোতা হয়ে শুনতে, শুনতে হাদারপার বাজার পৌছালাম।
টি ষ্টলে চায়ের দেশের সিলটি চা পান করে দ্রুত খেয়াঘাটে যাই কিন্তু পিয়ান নদীতে পানি কম থাকায়, হাঁটা ছাড়া উপায় নাই। চালক সোহেলের বুদ্ধিমত্তায় আরও একটি সিএনজি ভাড়া নেই।
এবড়ো-থেবড়ো জমিনের উপর দিয়ে গাড়ি চলল। ধীরে, ধীরে মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে, বিছনাকান্দির জল-পাথরের বিছানার দিকে এগিয়ে যাই। আমরা আফসোসে মরি, ঐ সবুজে মোড়ানো সারিবদ্ধ পাহাড়গুলো কেন এ দেশের হলো না? পাথরের ভাগাড় পিয়াইন নদী। তীরে সিএনজি থামে। অবাক বিস্ময়ে বিছনাকান্দির রূপ দেখি। কখনো হাঁটু, কখনো কোমর পানিতে নদী পাড়ি। এগিয়ে যাই প্রায় নো-ম্যান্সল্যান্ডের দিকে। বিজিপি এসে সতর্ক করলেন। এগিয়ে না গিয়ে থেমে যাই। এবার হিম, হিম ঠান্ডা পানিতে জলকেলিতে মেতে উঠি। বিছনাকান্দির পানিতে পরম আনন্দে অন্য পযটকদের সঙ্গেও ভাব জমিয়ে ফেলি।
স্থানীয়রা আফসোস শুনে সীমান্তের ওপারের বাজারে চা পান করতে নিয়ে যেতে চান। আমরা বারন করি। ভ্রমণের ষোলকলা তো পূর্ণ করি আমাদেরই ভূখন্ডে। কেন যেন সীমান্ত নিয়ে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কথা বার, বার মনে পড়ছিল। মওলানা বলেছিলেন, ‘জন্মভূমি আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও।’ তবে কেন আমাদের হলো না? কী কারণে হল না-জানি না! তবে আমাদের বিছনাকান্দি দারুণ। রয়েছে ছোট, বড় অগণিত পাথর, প্রকৃতির দারুণ সমারোহ। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে লাখো, কোটি পাথর। মনে হয়, পুরো এলাকাই পাথরের বিছানা। বিছানাকান্দির উত্তর পাশ আরও চমৎকার মায়াবি প্রকৃতিতে ঘেরা। এখানটায় মেঘালয় পাহাড়, ঢলের সাথে নেমে আসা পাথর আর পিয়াইন নদীর নিলাভ জলের মিতালি, বিছনাকান্দির প্রান্তরে আসা ভ্রমণপিপাসুদের মনে বারবার অন্যরকম অনুভূতিগুলোর দোলা দিয়ে যাবে।
স্বচ্ছ শীতল পানির তলদেশে পাথরের টল টলে পানি, অর্ধ ডুবন্ত পাথরে মাথা রেখে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে মন চাইবে। দীর্ঘ সময় জল পাথরের বিছানায় শুয়ে বসে গোসল করার পর আজানের ডাকে চেতনা ফিরে পাই। বিছনাকান্দির নৈসর্গিক সৌন্দর্য অসাধারণ। প্রকৃতির আপন লীলা খেলায় মেতেছে অপার সৌন্দর্যের জল পাথরের ভূমি! দৃষ্টির শেষ পর্যন্ত শুধু পাথর-পাহাড়। মন চায় না পানি থেকে উঠি। তবু যেতে হবে আপন নীড়ে। যখন ফিরি, মনে হয় পিছন থেকে ভারত সীমান্তের দিগন্ত ছোঁয়া মেঘালয় পাহাড় ‘দে-ছুট’ বলে ডেকে উঠে। আবেগে গেয়ে উঠি গান, ‘এত কাছে থেকেও তুমি কেন এত দূরে?’ পপ সম্রাট আজম খানের জনপ্রিয় একটি গান গাইতে, গাইতে ঢাকা ফেরার পথ ধরি-‘জমিনের বাসিন্দা আমি, তুমি থাক আসমানে। বিশাল ব্যবধান আছে, তোমার আমার মাঝখানে। চাইলে কি প্রেম করা যায়? যায় রে? কেমনে তোমার নাগাল আমি পাই? পাই রে? চাইলেই কী প্রেম করা যায়? যায় রে।’ যাতায়াত : দিনে-রাতে ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, গাবতলী হতে বিভিন্ন পরিবহনের এসি, নন এসি বাস সিলেটের পথে চলে। ভাড়া এসি ৯৫০-১২০০/=, নন এসি ৪৮০-৫৫০/= টাকা মাত্র। কমলাপুর হতে ট্রেনেও যাওয়া যায়। রাত যাপনে দরগা রোডে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। ভাড়া ৫০০/- টাকা হতে ৫০০০/- টাকা রুম। সিলেটের আম্বরখানা, হুমায়ুন চত্বর হতে সিএনজি, মাইক্রো ভাড়া সাড়া দিনে ২৫০০/- হতে ৪০০০/- টাকা । যাহারা অতি ব্যস্ত তাহারা আগের দিন রাতে সিলেট গিয়ে সারাদিন ঘুরে আবার রাতের বাসে ফিরতে পারেন।
ছবি : দে-ছুট, ফেসবুকে এই ভ্রমণ সংঘকে পাবেন-facebook.com/groups/dechut.
ওএস।