ধুলো পড়েছে বোল্টের রেকর্ড বুকে
যেকোনো রেকর্ড বুকে পৃষ্ঠা উল্টান। সেখানে খুঁজতে থাকুন বিশ্বরেকর্ড কিংবা সেরা পারফরম্যান্স, যা হয়েছে অলিম্পিক গেমস অথবা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের মতো প্রিমিয়ার অ্যাথলেটিকসে। আপনি স্প্রিন্ট বিভাগে দেখতে পাবেন একজনের আধিপত্য। তিনি জ্যামাইকান স্প্রিন্টার উসাইন বোল্ট, যার বেল্টের নিচে অসংখ্য রেকর্ড, যিনি পৃথিবীতে জীবন্ত এক দৃষ্টান্ত। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে গতির ঝড় তুলে এমনই সব কীর্তি গড়েছেন যা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এক কথায়- ধুলো পড়েছে বোল্টের রেকর্ড বুকে।
ক্রিকেট কিংবা ফুটবল বা অন্য খেলা, যেখানেই যখন কোনো অ্যাথলেট গতির ঝড় তুলেন, ধারাভাষ্যে ওঠে আসে বোল্টের নাম। গতিশীল কোনো কিছুর সঙ্গে জ্যামাইকান কিংবদন্তিই পৃথিবীতে সেরা উদাহরণ। হবেই না কেন? মাত্র ৯ দশমিক ৫৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌঁড় শেষ করার বিশ্বরেকর্ড যে তার দখলে। ২০০ মিটার এবং দলীয় ৪ গুনিতক ১০০ মিটার রিলেতেও ইতিহাসের অংশ জ্যামাইকান গতিদানব। এ নিয়ে কোনো তর্ক নেই যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্প্রিন্টার উসাইন বোল্ট, যার নাম খোদাই করা আরও অনেক বিশ্বরেকর্ডে।
ঢাকায় গত এক সপ্তাহে বাতাসের গতিবেগ কত ছিল? তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে এই তথ্য রেখেছেন অনেকেই। যারা রাখেননি তাদের জন্য বলা- সপ্তাহজুড়ে ঘণ্টায় গড়ে ১০ কিলোমিটারেরও কম ছিল বাতাসের গতিবেগ। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এর চেয়ে কয়েকগুন বেশি গতিবেগ তোলা নিয়মিত রুটিন ছিল বোল্টের। ধরা যাক, ২০০৯ আইএএএফ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের কথা। ওই ইভেন্টে ১০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ড গড়েন বোল্ট এবং তার গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ৩৭.৫৮ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ ওঠেছিল ৪৪.৭২ কিলোমিটার পর্যন্ত। এখন মজার ছলে আফসোস করে বলতেই পারেন -ইশ, যদি বোল্ট ছুটে যেতেন আমার পাশ দিয়ে, তবে ক্ষণিকের জন্য হলেও কমতো বাতাসের তেষ্টা।
বোল্ট তার সমস্ত তেষ্টা মিটিয়েছেন নিজ প্রজন্মে। ২০০৮ সালে নিউইয়র্কে রিবুক গ্র্যান্ড প্রিক্সে ১০০ মিটারে প্রথম বিশ্বরেকর্ড গড়েন ৯ দশমিক ৭২ সেকেন্ড টাইমিংয়ে। ওই বছরেই কয়েক মাস পর, বেইজিং অলিম্পিকে ৯ দশমিক ৬৯ সেকেন্ড নিয়ে ভাঙেন নিজের প্রথম রেকর্ড। পরের বছর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে আবারও ছাড়িয়ে যান নিজেকে। অর্থাৎ ১০০ মিটারে বোল্ট তার গড়া বিশ্বরেকর্ড ভাঙা-গড়ায় নেশায় ডুবে ছিলেন। ২০০ মিটারেও তার গল্পটা ঠিক একই। এই ইভেন্টে বিশ্বরেকর্ড গড়তে ২০০৯ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপকেই বেছে নেন তিনি।
বার্লিনে ওই ইভেন্টে বোল্ট স্বর্ণ জিতেছিলেন ১৯ দশমিক ১৯ সেকেন্ড টাইমিংয়ে। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে গড়া ১৯ দশমিক ৩০ সেকেন্ডের নিজ রেকর্ড ভাঙেন। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে বোল্ট আরেকটি ইতিহাস গড়েন তিন সতীর্থ- ইয়োহান ব্ল্যাক, নেস্তা কার্টার ও মাইকেল ফ্রাটারকে নিয়ে। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে চার জ্যামাইকান ৪ গুনিতক ১০০ মিটার দৌড় শেষ করেছিলেন মাত্র ৩৬ দশমিক ৮৪ সেকেন্ডে। এটা এখনো ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ ও অলিম্পিকে বিশ্বরেকর্ড। ১৫০ মিটারেও দ্রুততম মানব বোল্ট। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে ২০০৯ বিইউপিএ গ্রেট সিটি গেমসে দৌড় শেষ করেছিলেন মাত্র ১৪ দশমিক ৩৫ সেকেন্ডে।
বোল্টের ঝুলি ভরপুর গোল্ড মেডেলে। এথেন্স ২০০৪ অলিম্পিক হতাশায় পার করার পরই উত্থান তার। বেইজিং ২০০৮, লন্ডন ২০১২ এবং রিও ২০১৬- টানা তিন অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটারে স্বর্ণপদক জিতেন তিনি। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের ইতিহাসে এমন সাফল্য নেই অন্য কোনো স্প্রিন্টারের। তিন সংস্করণেই ৪ গুণিতক ১০০ মিটারে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন সাবেক জ্যামাইকান স্প্রিন্টার। দুর্ভাগ্যবশত একটি পদক হারান তার সতীর্থ নেস্তা কার্টার ২০১৭ সালে ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ হওয়ায়। আপিল করেছিলেন কার্টার। কিন্তু খেলাধুলার সর্বোচ্চ আদালত খারিজ করে দেয় সেই আপিল।
শুধু অলিম্পিক নয়, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপেও ইতিহাসের সেরা (পুরুষ) স্প্রিন্টার বোল্ট; জিতেছেন ১১টি স্বর্ণপদক। কিংবদন্তি স্প্রিন্টার তার বুটজোড়া তুলে রেখেছেন ২০১৭ সালে, যাকে হরহামেশা দেখা যায় ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টেনে বোল্টের ফুটবলার হওয়ার লোভ জাগে। হতে চেয়েছিলেন প্রিয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফুটবলার, কিন্তু দুই দিনের ট্রায়াল দেওয়ার সুযোগ মিলেন বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে। সেটা ২০১৮ মার্চে। ফুটবলার হওয়ার ভ‚ত এখনো নামেনি ৩৬ বছর বয়সী অ্যাথলেটের মাথা থেকে।
মাস দুয়েক আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ফুটবল ক্লাব মামেলোডি সানডাউনসের সঙ্গে অনুশীলন করেছেন বোল্ট। নতুন পাগলামী বিপরীতে পরিবার ও ব্যক্তিগত ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। সম্প্রতি অবশ্য বড় অঙ্কের আর্থিক লোকসান হয়েছে তার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে জানা যায়, বোল্টের অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হয়ে গেছে প্রায় ১২.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ওমন তথ্য জানাজানির পরই একাধিক নিউজে বলা হয়- সব হারিয়ে সর্বশান্ত বোল্ট!
আসলেই কি তাই? মোটেও না। সেলিব্রিটি নেট ওয়ার্থ ওয়েবসাইট অনুসারে, বোল্টের মোট সম্পদ ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার প্রজন্মে জ্যামাইকান স্প্রিন্টার ছিলেন বিশ্বের সর্বোচ্চ বেতনভোগী ক্রীড়াবিদ, প্রতি বছর আয় করতেন ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১২.৭ মিলিয়ন ডলার চুরি যাওয়ায় পথের ফকির হয়ে যাননি বোল্ট। ভেঙেও পড়েননি। তবে এত বড় ঘটনা চোখ খুলে দিয়েছে তার। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে যেভাবে তিনি ঘুরে দাঁড়াতেন, একইভাবে কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়ে দিব্যি হেসেখেলে পার করছেন বোল্ট।
কিংবদন্তি জ্যামাইকান অ্যাথলেটের জীবন সম্পর্কে উপলব্ধি এমন, ‘পরিশ্রম করে অর্জন করা কিছু হারানো যেকোনো ব্যক্তির জন্য দুঃখজনক ও কঠিন পরিস্থিতি। (টাকা চুরি যাওয়ায়) আমি অবশ্যই হতাশ। আমি খুব বেশি কিছু বলতে চাই না। না, আমি ভেঙে পড়িনি। এটা আমার জীবনে একটি বাধা সৃষ্টি করেছে। তবে এটা হয়তো আমরা ভাগ্যে ছিল। আমরা তিনটি বাচ্চা আছে, আমি এখনো বাবা-মায়ের দেখাশোনা করছি- আমি খুব ভালোভাবে বাঁচতে চাই।’
এমপি/এসএন