'আমার দেখা স্বপ্নের বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনাল'
বিশ্বকাপ ফুটবল প্রথম দেখি ২০০৬ সালে জামার্নিতে। সেখানে দুইটি ম্যাচ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। দুইটি খেলাই দেখেছিলাম ইংল্যান্ডের। কারণ আমি যেখানে ছিলাম ফ্রাঙ্কফুটে, সেখানে তখন ইংল্যান্ডের খেলা ছিল। এরপর গিয়েছিলাম ডর্টমুন্ডে। সেখানেও ছিল ইংল্যান্ডের খেলা। আমি কিন্তু আগে থেকে প্লান করে বিশ্বকাপে যাইনি। ব্যবসায়িক কারণে জামার্নি গিয়েছিলাম। তখন সেখানে বিশ্বকাপ ফুটবল চলছিল। সে সময়তো আর এখনকার মত অনলাইনে টিকিট কাটা যেত না। অফিসিয়ালি তখন কালোবাজারে টিকিট পাওয়া যেত। অনেক গুলো কোম্পানি আছে যারা বাড়তি দামে টিকিট বিক্রি করত। আমি আর আমার এক বন্ধু, সে ইংল্যান্ড থেকে গিয়েছিল। আমরা দুইটা টিকিটি কিনি। ব্যবসায়িক কাজ শেষ হওয়ার পর আমরা চলে আসি।
এরপর ২০১০ ও ২০১৪ সালে যাওয়া হয়নি। ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে আমি আবার দেখি। এবার আমি প্ল্যান করেই গিয়েছিলাম। আমি এক সময় রাশিয়াতে ব্যবসা করতাম। ওখানকার অনেকের সঙ্গেই পরিচয় ছিল, যারা বড় বড় ব্যবসায়ী। তো তাদেরকে দিয়েই টিকিট ম্যানেজ করি। আমার যাওয়ার মূল কারণই ছিল ব্রাজিলের খেলা দেখা। আমি ব্রাজিলের একনিষ্ঠ সমর্থক। শেষ ষোলর খেলা ছিল। ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ছিল মেক্সিকো। ব্রাজিল খুব সম্ভবত ২-০ গোলে জিতেছিল। তারপর কোয়ার্টার ফাইনালে খুবই দুঃখজনকভাবে ২-১ গোলে বেলজিয়ামের কাছে হেরে যায়। তখন আর বাকি খেলাগুলো দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। যদি ব্রাজিল বিদায় না নিত, তা’হলে সেমি ফাইনাল, এমন কি ফাইনালও দেখতাম।
এরপর আসে এবারের কাতার বিশ্বকাপ। এবারের বিশ্বকাপটা আসলে পুরোপুরি প্লান করা। গুলশান ক্লাবের একটা জায়গা বসে আমরা যেখানে বসে আড্ডা মারি, গল্পকরি, সেখানে বসেই প্রথম এই পরিকল্পনা করা হয়। সেখান থেকেই শুরু কাতার বিশ্বকাপের মিশন। জামানকে বলি। সে রাজি হয়ে যায়। জামানও আগে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখেছে। সে আর আমি প্রথম পরিকল্পনা করি। অনেকেই সায় দিল। আস্তে আস্তে দেখলাম আমরা ৮/১০ জন হয়ে গেছি। আমার সঙ্গে ছিল বিসিবির সাবেক পরিচালক শওকত আজিজ রাসেল, যমুনা গ্রুপের শামীম ছিল, মেট্টো গ্রুপের জহির, ভাসাবির জামান, আওয়ামী লীগের আলাউদ্দিন নাসিম ভাই।
প্রায় এক বছর আগে টিকিট বুকিং দিয়েছিলাম ডিসকভারি ট্রাভেলসের মাধ্যমে। আমাদের প্যাকেজ দিয়েছিল। হোটেল বুকিংটা সুন্দর হয়েছে। হোটেল বুকিংটাও কিন্তু আমরা ৬ মাসে আগে করেছিলাম। কারণ আমরা জানি যে পরের দিকে গিয়ে হোটেল পাওয়া যাবে না। সেটাও আমাদেরকে ডিসকভারি করে দিয়েছে। আসলে আমরা শুধু গিয়ে প্লেনে উঠেছি আর টাকা দিয়েছে। বাকি সব অ্যারেজমেন্ট ডিসকভারি ট্রাভেলস করে দিয়েছে একটা প্যাকেজের মাধ্যমে। তারা খুব ভালো সার্ভিস দিয়েছে। সব কিছু অন টাইম ডেলিভারি দিয়েছে। তাদেরকে ধন্যবাদ সুন্দর ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য।
আমরা একটি প্যাকেজে হসপিটালিটি বক্সের টিকিট নিয়েছিলাম, যেখানে দুইটা সেমি ফাইনাল, থার্ড-ফোর্থ প্লেস ম্যাচ ও ফাইনাল খেলা ছিল। অর্থাৎ টপ ফোর ম্যাচের প্যাকেজ আমরা কিনেছিলাম। আমি আগেই চিন্তা করেছি এবার ফাইনাল দেখতেই হবে। কারণ বয়স হয়ে গেছে। আগামীতে আর দেখতে পারবো কি না জানি না। আবার ৪ বছর পরে বিশ্বকাপ।
আগেই বলেছি আমি ব্রাজিলের একনিষ্ঠ সমর্থক। প্যাকেজে ফাইনাল পর্যন্ত টিকিট কেটেছি ব্রাজিল ফ্রাইনাল খেলবে আশা করে। ঘরের কাছে বিশ্বকাপ। নিজেদের মহাদেশে বিশ্বকাপ। অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করা। বিশ্বকাপ শুরুও হয়ে গেছে। আমাদেরও যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। মনে মনে অন্য রকম উত্তেজনা কাজ করছে। ব্রাজিলও ভালো খেলছে। মাঠে বসে প্রিয় ব্রাজিলের খেলা দেখব। নেইমারের খেলা দেখব। কিন্তু যাওয়ার আগে সব উত্তেজনা মাটি চাপা পড়ে যায়। বিমানে উঠার আগেই ব্রাজিলের বিদায়! কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে গেছে। তো মনটা আসলে খুবই খারাপ হয়ে যায়। ভাঙ্গা মন নিয়েই গেলাম কাতারে।
যেহেতু বিশ্বকাপ ফুটবল। তাই মন খারাপ করে বসে থাকার সুযোগ কম। আমিও খুব বেশি সময় মন খারাপ করে থাকতে পারিনি। মনকে প্রফুল্ল করে তুলি এই ভেবে যে অন্তত ফাইনাল দেখতে পারব। এই একটা স্বান্তনা থাকবে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট ফাইনাল দেখেছি কয়েকবার। ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল কখনও দেখিনি। সেমি ফাইনালও দেখিনি। এবার অন্তত এই ম্যাচগুলো দেখা হবে। এ ছাড়া আরেকটি অনুপ্রেরণা ছিল সেটা হলো মেসি। ব্রাজিল বিদায় নিয়েছে ঠিক আছে মেসিতো আছে। তার খেলাটা অন্তত মাঠে বসে স্বচক্ষে দেখি। আমি খুব মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম যেহেতু ব্রাজিল নেই, মেসির হাতে কাপটা উঠুক। কারণ মেসি এমন একজন খেলোয়াড় যার হাতে সব ট্রফিই উঠেছে। শুধু বিশ্বকাপ ট্রফি উঠেনি। তাই আমি খুব বেশি করে চাচ্ছিলাম মেসির হাতে যাতে কাপটা উঠে।
মেসি এমন একটা ক্যারেক্টার আপনি কিন্তু কখন বলতে পারবেন না মেসি সর্ম্পকে কোনও নেগেটিভ নিউজ পত্রিকায় এসেছে। পারিবারিক ভাবে হোক, সামাজিকভাবে হোক, খেলোয়াড় জীবনে হোক, সে এতো মার্জিত, ট্রু লিজেন্ড যাকে বলে। আমরা যদি লিজেন্ড খুঁজতে যাই, ম্যারাডোনাও কিন্তু লিজেন্ড। তার অনেক বদনাম ছিল। কিন্তু মেসি এমন একজন প্লেয়ার যার সর্ম্পকে কখনও কোন নেগেটিভ নিউজ দেখিনি পত্রিকায়। এ রকম একজন স্বয়ংসম্পূর্ন খেলোয়াড়, এ এরকম একজন লিজেন্ড, ওয়ার্ল্ড ফুটবলে আর আসবে কি না আমার সন্দেহ আছে। আমিতো মনে করি বিশ্বকাপ জেতার পর মেসিই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। কারণ এই একটা জিনিষই তার বাকি ছিল। সেটা সে অর্জন করেছে। খুবই ভালো লাগছে, যখন দেখেছি ফাইনালে শেষে মেসির হাতে কাপটা উঠেছে।
বিশ্বকাপের ট্রফি মেসির হাতে উঠতে গিয়ে এমন একটা ফাইনাল আমরা দেখলাম, এ রকম ফাইনাল আবার কখন, কে দেখবে আমার আসলে জানা নেই। এ রকম একটি রূদ্ধশ্বাস ফাইনাল, অতিরিক্ত সময়ে গিয়েও কিন্তু রূদ্ধশ্বাসের হাতছানি। আর্জেন্টিনা দুই গোল দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পর খেলায় সমতা। আবার অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে মেসির গোলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে যাওয়ার পর এমবাপ্পেরে হ্যাটট্রিক গোলে খেলায় আবার সমতা।
স্পোর্টসের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে ফুটবল, ক্রিকেটে। আমি নিজেও খেলেছি। খেলার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ আছে। আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার পরও মনের মাঝে একটা খছখছানি ছিল এমবাপ্পেকে নিয়ে। প্রথমার্ধে তাকে অনেক নিষ্প্রভ মনে হয়েছে। কেন জানি আমার মনে হয়েছিল দ্বিতীয়ার্ধে সে জ্বলে উঠবে এবং সে যদি জ্বলে উঠে, তাহলে কিন্তু আর্জেন্টিনার জন্য জেতাটা কঠিন হয়ে যাবে। ঠিকই কিন্তু এমবাপ্পে জ্বলে উঠেছিল। খেলায় সমতা নিয়ে আসল। ২-২ গোলে নির্ধিারিত সময় খেলা শেষ হয়। খেলা শেষ হওয়ার আগে কিন্তু বলা যাচ্ছিল না মেসির হাতে শিরোপা উঠবে কি না।
ফ্রান্স যখন দুই গোলই শোধ করে ফেলল, আমি কিন্তু এক পর্যায়ে ভেঙ্গেই পড়লাম মেসির বোধহয় আর কাপটা জেতা হলো না। কারণ দুই গোলে এগিয়ে থাকার পর সমতা আনায় মানসিক দিক দিয়েতো আর্জেন্টিনার থেকে ফ্রান্সের খেলোয়াড়রা অনেক এগিয়ে। ফ্রান্সের আক্রমণের পর আক্রমণ, শরীরি ভাষা, মনে হয়েছে প্রতি মুহুর্তে তারা গোল করে বসবে, আর্জেন্টিনা গোল খেয়ে যাবে- এ রকম একটা ব্যাপার। এরপর খেলার শেষ দিকে গিয়ে ফ্রান্সের একজন খেলোয়াড়, এ মুহুর্তে নাম পড়ছে না, সে যদি পা টা ছোঁয়াতে পারতো তাহলে কিন্তু গোল হয়ে যায়। তখন সব শেষ হয়ে যেত!
এ রকম একটা ম্যাচের পর মেসি যখন কাপটা জিতল, তা দেখতে পেয়ে আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি। আমি মনে করি জীবনে শ্রেষ্ঠ একটা ফাইনাল দেখলাম। এরচেয়ে স্বস্তির আর আনন্দের বিষয় কিছু হতে পারে না।
এ রকম একটি জমজমাট ফাইনালআর কোনও বিশ্বকাপের ঘটেছিল কি না আমার জানা নেই। ভবিষ্যতে ঘটবে কি না, কেউ বলতে পারবে না। জীবনে একটাই ফাইনাল দেখলাম এবং সেটাই স্মরণীয় ফাইনাল। নিজের কাছে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে হয়েছে যে মাঠে থেকে এ রকম একটি ফাইনাল দেখতে পেরেছি। সব মিলিয়ে এই বিশ্বকাপটা ছিল স্বপ্নর মত। ব্রাজিল হেরে যাওয়ার পর যে রকম একটা হৃদয় ভাঙ্গা মন নিয়ে গিয়েছিলাম, মেসির হাতে বিশ্বকাপটা দেখার পর সেই দুঃখটা আসলে ভুলে গেছি। দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনার ফসল সার্থক হয়েছে। এখন পর্যন্ত যত ফুটবল-ক্রিকেট দেখেছি এবারের বিশ্বকাপের ফাইনাল Best in my life.
সামনে হয়তো মেসির নাম বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে উচ্চারতি হবে। আমি যদি সেখানে পার্টিসিপেট করি, তাহলে বলতে পারবো হ্যাঁ আমি মেসির খেলা মাঠে বসে দেখেছি। সেটি ছিল বিশ্বকাপের ফাইনালে। এই আনন্দটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। ঐ দিন রাতে আমরা অনেক মজা করেছি। ফাইনাল শেষেও আমরা অনেক মজা করেছি।
ব্রাজিলের সাপোর্টার হওয়ার পরও ফাইনালের দিন কিন্তু আমি আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিয়েছিলাম। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে তুমি আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিয়েছ? আমি বললাম কেন? আমার ব্রাজিলতো নেই। আমিতো মেসিকে সাপোর্ট করছি। তো আর্জেন্টিনার জার্সি পড়লে সমস্যা কি? আমার সবাই অফিসিয়াল দোকান থেকে গিয়ে আর্জেন্টিনার জার্সি কিনেছি। সৌভাগ্যক্রমে মেসির জার্সি পেয়ে গিয়েছিলাম। ৩/৪ টা ছিল, আমরা কিনে নেই। আর্জেন্টিনার জার্সি পরে খেলার দেখার ছবি আমি ফেসবুকেও দিয়েছি।
মেসিকে প্রথম দেখি আমি সেমি ফাইনালে। মাঠে ঢুকার আগে অন্তরে অন্যরকম উত্তেজনা টের পেলাম। ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তির খেলা সামনা সামনি মাঠে বসে দেখব। সকাল থেকেই নিজের মাঝে উত্তজনা টের পাচ্ছিলাম। সময় যেন আর শেষ হতে চাচ্ছিল না। কখন মাঠে যাব। মেসির খেলা দেখব। উত্তেজনায় মনে হয়েছে দেহের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। সব উত্তেজনা পেছনে ফেলে অবশেষে লুসাইল স্টেডিয়ামে প্রবেশ করি। এই স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনা বেশ কয়েকটি ম্যাচ আগে খেলেছে। এমন কি নিজেদের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরেও ছিল। এ সবও মনে পড়ল।
খেলা শুরুর অপেক্ষা করছি। স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক। আর্জেন্টিনার জার্সিতে সয়লাব। আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা মেসে মেসি ধ্বনিতে মুখরতি গোটা স্টেডিয়াম। আর্জেন্টিনা দল মাঠে নামার পর আমার নয়ন দুইটি শুধুই মেসিকে খুঁজছে। মেসি কোথায়, মেসি কোথায়। মেসিকে দেখার পর নয়ন যেন স্বার্থক হয়। শরীরের ভেতর অন্য রকম অনুভুতি জাগে। বিশ্বের সেরা একজন খেলোয়াড়। একটি দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জীবন্ত মেসিকে দেখার পর অপেক্ষা করতে থাকি মেসির যাদুকরি খেলা দেখার। সেখানেও নয়ন স্বার্থক হয। মেসি এক গোল করে। ম্যাচ সেরাও হয়। কি সাবলিল অসাধারণ খেলা। ছোট-খাট গড়নের একটি মানুষের খেলা দেখে নয়ন জুড়ে যায়। এতোদিন মাঝে মাঝে টিভিতে তার খেলা দেখেছি। এবার সরাসরি মাঠে বসে প্রথম দেখা। কি যে ভালো লেগেছে বলে বুঝানো যাবে না। নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে।
কাতার বিশ্বকাপের ম্যানেজমেন্ট দারুণ। কাতারের মত ছোট্ট একটি দেশের একটি শহরে একটি বিশ্বকাপের আয়োজন এক কথায় অবিশ্বাস্য। আপনি দেখেন আগে যত বিশ্বকাপ হয়েছে, পুরো দেশে হয়েছে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যেতে অনেক সময় লেগেছে। বিমানেও যেতে হয়েছে। এখানে কোনও বিমানের ব্যাপারই নেই। গাড়িতে করেই চলে গেছে সবাই যে যার মত করে। ম্যাক্সিমাম এক ঘন্টা, দেড় ঘন্টা কিংবা দুই ঘন্টা সমেয় লেগেছে।
যে মাঠে ফাইনাল খেলা হেয়েছে, তা খুবই দৃষ্টিন্দন। এ রকম স্টেডিয়াম চিন্তাই করা যায় না। কাতারের মত একটা দেশ যে স্টেডিয়াম তৈরি করেছে, মানে অবিশ্বাস্য। আমাদের হসপিটালিটি বক্সের টিকিট ছিল। এখানে তারা যেটি করেছে আমার কাছে মনে হয়েছে ব্যতিক্রম। তারা হসপিটালিটির ব্যবস্থা করেছে স্টেডিয়ামের বাইরে। ওখানে বিরাট এক লাউঞ্জের মত করেছে। যারা শুধু হসপিটালিটি টিকিট কেটেছে তাদের জন্য। ঐ লাউঞ্জে সব খাওয়া ফ্রি। ওখানে বিভিন্ন রকমের শো হচ্ছে। বিভিন্ন কিছু বিক্রি হচ্ছে। খুবই ভালো সময় সেখানে কাটাতে পারবেন। এ রকম আয়োজন সেখানে। আপনি সেখানে তিন ঘন্টা আগে গিয়ে বসে থাকেন। খাওয়া-দাওয়া করেন। আনন্দ করেন। গল্প-গুজব করেন।
কাতার বিশ্বকাপের একটি ত্রুটি আমার চোখে পড়েছে। সাধারণত যারা হসপিটালিটি বক্সের টিকিট কেটে থাকেন তারা কিন্তু খুবই আরাম করে খেলাটা দেখেন। কিন্তু আমাদের হসপিটালিটি গ্যালারিটা তারা এমন জায়গায় করেছে, যে কোনও লিফটের ব্যবস্থা নেই। আমাকে সাত তলা পর্যন্ত সিড়ি বেয়ে উঠতে হয়েছে। স্টেডিয়ামের সাত তলা হওয়াতে সাধারণ বিল্ডিংয়ের এগারতলার সমান। প্রতি ম্যাচে এতো উপরে উঠা, এটা আসলে দুর্বিষহ। ওখানে যে লিফট আছে তা শুধু যারা হুইল চেয়ার এসেছে এবং যারা শারীরিকভাবে অসুস্থ তারা ব্যবহার করতে পেরেছে। অন্য কারও জন্য কিন্তু লিফটের কোনও ব্যবস্থা নেই। বাদ বাকি সবাইকেই হেঁটে উপরে উঠতে হয়েছে।
এতো টাকা দিয়ে আমি হসপিটালিটি বক্সের টিকিট কিনলাম আর আমাকে হেঁটে উপরে উঠতে হবে! যদি আমার হার্টের সমস্যা থাকে, আমার যদি অন্য প্রবলেম থাকে। আমি কিভাবে তাদেরকে বুঝাব যে আমার হার্টের সমস্যা আছে। আমিতো জানি না যে আমাকে হেঁটে উপরে উঠতে হবে। আগে জানলে অসুস্থতার কাগজ-পত্র নিয়ে যেতাম। আমি দেখেছি অনেক বয়স্ক মহিলা, এমন কি পুরুষ মানুষ যারা খেলা দেখতে গিয়েছে, তারা যে কি কষ্ট করে উপরে উঠেছে। অনেককে তিন তলা-চার তলা উঠার পর বসে পড়েছে, পানি খাচ্ছে। কাতারের বিশ্বকাপের যদি কোনও ত্রুটি থেকে থাকে, তাহলে এটি একটি বড় ত্রুটি।
আমি মনে করি হসপিটালিটি বক্সের টিকিট যারা কিনেছেন, তাদের জন্য অবশ্যই লিফটের ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল। না হলে আপনি এতো টাকা দামের টিকিট কিনবেন কেন? আমাকে যদি এ রকম হেঁটে উপরে উঠতে হবে জানতাম, তাহলে আমি নরমাল গ্যালারির টিকিট কিনতাম। কিন্তু আমি তা জানি না। আমিতো ভাবছি আমি আরামে খেলা দেখব। স্টেডিয়ামে যাব, গ্যালারিতে ঢুকে পড়ব, খেলা দেখব। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমাকে ভীষন হতাশ করেছে। প্রত্যোকটা ম্যাচে আমাদের এভাবে সিড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। বয়সতো আমাদের কম হয়নি। ষাটের কাছাকাছি। এই বয়সে তো উপরে সিড়ি বেয়ে উঠে খেলা দেখা আসলে একটা দুর্বিষহ অবস্থা। কিন্তু এতো কষ্ট করে যখন মাঠে ঢুকতাম, তখন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যেত। মাঠে ভেতর হাজার হাজার দর্শক। চমৎকার স্টেডিয়াম, ব্যাণার ফেস্টুন, ঢোল বাজাচ্ছে। এ এক এলাহি ব্যাপার।
বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে না গেলে আমি আসলে বুঝতে পারতাম না ফুটবল খেলা যে আসলে কী। মানুষের মাঝে কি রকম উন্মাদনা। আগে হয়তো টিভিতে দেখেছি। এবার স্বশরীরে দেখলাম। চোখের সামনে দেখার একটা আনন্দ, এক্সাইটমেন্ট, আসলে এটা বলে বলার মত না।
আর্জেন্টিনার দর্শকদের কাছে আমরা বাংলাদেশিরা ছিলাম খুবই আগ্রহের কেন্দ্র-বিন্দুতে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল আর্জেন্টিনার অনেক দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেছি, ছবি তুলেছি, এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেছি। বাংলাদেশ নিয়ে ব্যাপক আগ্র দেখিয়েছে। জানতে চেয়েছে। আবার অনেকেই বাংলাদেশ সম্বন্ধে বেশ ভালোই জানে। বাংলাদেশে যে মেসির এ রকম ক্রেজ আছে, আর্জেন্টিনার ক্রেজ আছে, সেই বার্তাটা কিন্তু তারা জেনে গেছে।
আর্জেন্টিনার যারা ইংরেজি জানে, অনেকেই আবার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে আমাদের দেশের ফুটবেলর অবস্থা কি তা জানতে চেয়েছে। সত্যি কথা বলতে গিয়ে আমাকে হতাশ হয়েই ফুটবলের দৈন্যদশার কথা বলতে হয়েছে। কিন্তু মেয়েদের ফুটবল নিয়ে আমি আবার উচ্চাশা ব্যক্ত করেছি। হাইলাইটস করেছি। আমি তাদের জানিয়েছি আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো ক্রিকেট। আর্জেন্টিনার যেরকম ফুটবল, আমাদের সেরকম ক্রিকেট। তারা বলেছে তাদের দেশে সে রকম ক্রিকেট খেলা হয় না। তাদের আমি বলেছি তোমরা যদি আমাদের মত বেশি বেশি ক্রিকেট খেলতে, তাহলে বুঝতে পারতে আমাদের দেশে ক্রিকেটে কতোটা জনপ্রিয়। ক্রিকেটে বিশ্বে আমরা সাত নম্বার। যেহেতু তোমার ক্রিকেটে সেভাবে খেল না, তাই তোমাদের এ বিষয়ে সে রকম ধারনা নেই। আমাদের দেশ বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড লেবেলে একটি খেলাই খেলে থাকে, সেটি হলো ক্রিকেট। আমাদের বিশ্ব মানের অনেক ক্রিকেটার যে আছে তাদের নাম বলি। আমি সাকিব, মাশরাফি, মুশফিকের নাম তাদের বলি। আর কোনও খেলা আমরা ওয়ার্ল্ড লেবেলে সেভাবে খেলি না। এ ছাড়া আমি আরও কয়েকটি খেলার কথা জানিয়েছি তাদেরকে। শ্যুটিংয়ে আমরা অতীতে গোল্ড মেডেল পেয়েছি। এ রকম কিছু বলেছি। এ রকম অনেক বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের মত বিনিময় হয়েছে।
খেলাধুলার ছাড়াও তারা আমাদের সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানতে চেয়েছে। পরিবেশ সম্বন্ধে জানতে চেয়েছে। তারা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে এতো অল্প জায়গার মাঝে ১৭ কোটি লোকের বসবাস করা জেনে। এটা জানার পর একজন আমার কাছে জানতে চায় আমাদের এখানে মারামরি হয় কি না? আমার কাছ থেকে ‘না’ শব্দটি শুনার পর তারা বেশ অবাকই হয়েছে। আমি তাদের বলি বাংলাদেশ বিশ্বে এমন একটি দেশ যেখানে সবচেয়ে কম বর্গফুট এলাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে। দেখবেন ২০ তলা বিল্ডিং, বিশাল অট্টালিকা। তার পাশেই নিচে বস্তি। একই সঙ্গে তারা সমানভাবে বসবাস করছে। কারও প্রতি কারও কোনও বিদ্বেষ নেই, হিংসা নেই, মারামারি নেই। সৌহার্দ্যপূর্ণ দেশ। এটা কিন্তু পৃথিবীতে বিরল। আসলে আমি আমাদের দেশের ভালো বিষয়গুলো তাদের সামনে হাইলাইটস করার চেষ্টা করি। তারাও অ্যা্প্রিসিয়েট করে। আরও অনেক বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে।
আমরা ফ্রেন্ডরা যারা ওখানে খেলা দেখতে গিয়েছিলাম, তারাতো খেলা শেষে আনন্দ করতাম, আড্ডা দিতাম। লং ড্রাইভে চলে গিয়েছি, ক্রজে গিয়েছি। আসলে ১১টা দিন যে কিভাবে চলে গেল আমরা টেরই পাইনি। মনে হয়েছে এইতো সেদিন আসলাম আর এখনি চলে যাচ্ছি। আসলে একটা সফল স্বপ্ন ছিল কাতার বিশ্বকাপ। যে একটা উন্মাদনা নিয়ে গিয়েছিলাম, যদিও ব্রাজিলের হারটা কষ্ট দিয়েছে। ব্রাজিল যদি সেমি ফাইনাল পর্যন্ত যেত পারত, তাহলে হয়তো আমার সফরটা ষোলকলা পূর্ণ হতো। খেলায় হারজিত আছেই। ব্রাজিলও হেরে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু ফাইনালি মেসির যে জয়টা দেখতে পেলাম, সেটি হচ্ছে আমার জীবনের মধুর একটি দিন এবং যে ফাইনালটা দেখলাম এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেরা ফাইনালই। সব মিলিয়ে অভূতপূর্ব একটা সফর ছিল কাতার বিশ্বকাপ।
নাসিম (আলাউদ্দিন নাসিম) ভাই ছিলেন আমাদের মুরুব্বি। উনি সবাইকে লিড করতেন। সেখানে নাসির ভাইয়ের এলাকার কয়েকজন লোক থাকত। তারা একেবারে ল্যান্ডক্রজার গাড়ি নিয়ে আসত। তারা আমাদের অনেক সার্ভিস দিয়েছে। কেনাকাটা করতে, কোথায় কোন জিনিস ভালো পাওয়া যাবে নিয়ে গেছে। যেমন অফিসিয়াল মার্চেনডাইজ আমি খুঁজছিলাম। ঐ ছেলেটা আমাদেরকে নিয়ে যায়। আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের ১০ জনের দল ছিল। দুইটা গাড়ি লাগত। নাসিম ভাই প্ল্যান করে দিতেন কেকোন গাড়িতে উঠবে। কারণ এক গাড়িতেতো আর সম্ভব নয়। কোন জায়গায় মিলিত হবো তিনি বলে দিতেন। কখন কোথায় খেতে যাব। কোথায় বেড়াতে যাবে। উনিই ঠিক করতেন। আসলে উনি ছিলেন আমদের টিম লিডার। পুরো সফরটা এতো চমৎকার আর আনন্দঘন পরিবেশে হয়েছে।
রাতে রাসেলের একটা স্যুট ছিল, সেখানে আমরা সবাই মিলে আড্ড দিতাম। খাওয়া-দাওয়া করতাম। আসলে ঘুমানোর যেন সময় ছিল না। এই ৩/৪ ঘন্টা হয়তো আমরা ঘুমাতাম। বাকি সময়টা সবাই আনন্দ-ফূর্তি করেই কাটিয়েছে। অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা।
এরপর যদি বেঁচে থাকি তখন বয়স হবে ৬৪। জানি না সামনে বেঁচে থাকলে হয়তো বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়া হবে। তারপরতো আসলে আর সম্ভব হবে না। সুতরাং নেক্সট বিশ্বকাপ যদি বেঁচে থাকি সুস্থ থাকি তা’হলে শেষ বিশ্বকাপ হিসেবে দেখতে যেতে পারি। এরপর বয়স ৭০র কাছাকাছি হয়ে যাবে। তখন আর যাওযা হয়তো আরা সম্ভব হবে না শরীর পারমিট করবে না। সব কিছু মিলিয়ে আসলে আর যাওয়া হবে না। তাই পরের বিশ্বকাপ যদি সুস্থ থাকি, পরিবারের সবাই ভালো থাকে তাহলে আশা করি দেখার ইচ্ছে আছে। এবং সেটা শুধুই ব্রাজিলের জন্য। তখন হয়তো কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই দেখার পরিকল্পনা করব।
লেখক: খন্দকার জামিলউদ্দিন, পরিচালক, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেড
অনুলিখন: মহিউদ্দিন পলাশ, হেড অব স্পোর্টস, ঢাকাপ্রকাশ