ফুটবল ঈশ্বরের দেশে বরপুত্র মেসি
ডিয়েগো ম্যারাডোনা যখন বিশ্বকাপের ট্রফি বাড়ি নিয়ে হাজির, তখন পৃথিবীর আলো দেখেনি লিওনেল মেসি। মেসি যখন বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে বাড়িমুখো, ততদিনে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন ম্যারাডোনা। দুই প্রজন্মের দুই কিংবদন্তি তাই একত্রিত হতে পারেনি বিশ্বজয়ের আনন্দে। সবার সব চাওয়া যেমন পূর্ণ হয় না, তেমনি দুজনার এই আক্ষেপের চাদরে মোড়ানো আর্জেন্টাইনরাও। আবার সৌভাগ্য তাদের, ফুটবল ঈশ্বরের দেশে পেয়েছে মেসি নামক রাজপুত্রকে।
কী আছে আর্জেন্টিনার? বলতে পারবেন, বিশ্ববাজারে কতটা শক্তিশালী কিংবা প্রভাব রয়েছে লাতিনের দেশটির? ইতিহাস ঘেঁটে হয়তো বলতে পারবেন, সংঘাতময় রাজনীতির বুক চিড়ে জন্ম তাদের। আয়তনে দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র। ব্যাস, এতটুকুই। আর কিছু বলার চেষ্টা যাবে বৃথা। তবুও বড় এক নাম আর্জেন্টিনা। তাদের পতাকা উড়ে বিশ্বজুড়ে। সবাই চেনে এক নামে। চিনিয়েছেন ম্যারাডোনা। চিনিয়েছেন তারই যোগ্য উত্তরসূরী মেসি।
এটা মানা হয়, ফুটবলের সৌন্দর্য লাতিন অঞ্চলে, যার প্রবর্তক ম্যারাডোনা। হাত, পা, মাথা কিংবা শরীর, তার সবটাই নেচে উঠত ফুটবলের ছোঁয়ায়। সঙ্গে নাচত বিশ্ব। তার ফুটবল জাদু এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে চোখের সামনেও তার ভুলগুলো সঠিক মনে হতো। যেমন- বিখ্যাত সেই হ্যান্ড অব গডের ঘটনা। কেউ বুঝতেই পারেনি, হাতের ছোঁয়ায় গোল করেছিলেন তিনি। সবাইকে বোকা বানিয়ে ফিরেছিলেন বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে।
১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী ম্যারাডোনা মুহূর্তেই জন্মভূমিতে হয়ে যান ফুটবল ঈশ্বর। অথচ কতই না কলঙ্ক ছিল এই ফুটবল ঈশ্বরের- একাধিক বিয়ে, ডোপ ও নারী কেলেঙ্কারি, মদের নেশায় ডুবে থাকা এবং প্রকাশ্যে ধূমপান। তার এমন খামখেয়ালি জীবনযাপন অকালে কেড়ে নিয়েছে তাকে, যিনি জীবনদশায় একটিবার দেখতে চেয়েছিলেন মেসির হাতে বিশ্বকাপ। স্বপ্নপূরণে ডাগআউট হতে গ্যালারি, সবখানেই সরব উপস্থিতি ছিল তার।
কিন্তু ভাগ্যবিধাতা হয়তো চায়নি, তাইতো ম্যারাডোনা স্বর্গবাসী হওয়ার পর বুড়ো বয়সে মেসির হাতে তুলে দেন আরাধ্য শিরোপা। হ্যাঁ, ম্যারাডোনাহীন পৃথিবীতে মেসি এখন বিশ্বজয়ী ফুটবলার। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা ও ২০২২ সালে ফাইনালিসিমা জয়ের পর, গুনে গুনে পাঁচবারের প্রচেষ্টায় ৩৫ বছর বয়সে লা আলবিসেলেস্তেদের ৩৬ বছর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছেন। কাতারে ৬৯০ মিনিট খেলে ৭ গোল ও ৩ অ্যাসিস্টে রূপকথার গল্প লিখেছেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক।
কোটি কোটি ভক্তকে মেসি উপহার দিয়েছেন বিশ্বকাপ ট্রফি এবং নিজে জিতেছেন গোল্ডেন বল ও সিলভার বুট। তার ওমন জাদুকরি পারফরম্যান্সের পর ফুটবল ঈশ্বরের দেশে মেসিকে রাজপুত্রের আসনে বসিয়েছে আর্জেন্টিনা। মাসখানেক আগে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ) তাদের ট্রেনিং ফ্যাকাল্টির নামকরণ করেছে মেসির নামে।
সাউথ আমেরিকান ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা কনমেবলের প্রেসিডেন্ট আলেহান্দ্রো ডোমিনগেজ মেসিকে ফুটবলের শাসক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। প্যারাগুয়ের লুকে শহরে কনমেবলের সদর দপ্তরে পেলে ও ম্যারাডোনার পাশে স্থাপন করা হয়েছে মেসির ভাস্কর্য। খুদেরাজকে একের পর এক সম্মানে সম্মানিত করেও মন ভরছে না ফুটবল সংশ্লিষ্টদের, বিশেষ করে ভক্তদের। যেমন- গত মার্চে ফিফা উইন্ডোতে প্রীতি ম্যাচ খেলতে জন্মভূমিতে যান মেসি। ব্যস্ততার ফাঁকে পরিবার নিয়ে গিয়েছিলেন রেস্টুরেন্টে। সেখানেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন ভক্তদের ভিড়ে!
ভালোবাসার বিড়ম্বনা বলতে যা বোঝায় সেটাই সেদিন টের পান মেসি। তাতে যে মেসি মনক্ষুণ্ন তা বলা যাবে না কোনোভাবেই। কেননা, ভালোবাসার কাঙাল ফুটবলের রাজপুত্র। ফুটবল ভালোবাসেন তিনি। ভালোবাসেন প্রিয় ভক্তদের। তাই তো ২০২৬ বিশ্বকাপের প্রসঙ্গে আর্জেন্টিনার এই প্রতিনিধি বলে রেখেছেন, যদি শরীর পক্ষ নেয় তার এবং সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তাহলে পরের বিশ্বকাপেও দেখা যাবে তাকে। কী হবে তা বলে দেবে সময়। তবে আপাতত এতটুকু বলাই যায়- মেসি বেঁচে আছেন ফুটবল নিয়ে।
এসজি