মেসি ‘আর্জেন্টাইন ঈশ্বর’
প্রতিভাবানদের একজন লিওনেল মেসি। পর্তুগিজ তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে দ্বৈরথ কখনো থামাননি তিনি। তবে ২০০৯ সালে রোমে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদোর দল রিয়াল মাদ্রিদক উড়িয়ে দিতে বার্সেলোনাকে সাহায্য করেন মেসি। কীভাবে ফুটবল বিশ্বের সেরাদের কাতারে নাম লেখালেন মেসি?
২০০৫-০৬ সালে মেসির পারফরম্যান্সগুলোর মাধ্যমে তাকে নিয়ে উৎসাহের সূচনা ঘটে। যা তাকে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে দেয়। একজন ফরোয়ার্ড অথবা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে মেসির অসাধারণ বল নিয়ন্ত্রণ দক্ষতা, বল নিয়ে দ্রুত দৌড়ানো এবং ফুটবলে অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা তৈরির ক্ষমতা তাকে করে তুলেছে ফুটবল বিশ্বের নিখুঁত খেলোয়াড়দের একজন।
একেবারে ছোট্ট একজন খেলোয়াড় থেকে বিশ্বের অন্যতম ক্লাব বার্সেলোনা মেসিকে পূর্ণতা দিয়েছে ধীরে ধীরে। বিশ্বের সবচেয়ে সেরা আসরে তাকে যোগ্যতম করে তুলেছেন তারা। নিজের অসাধারণ দক্ষতায় তার দেশ আর্জেন্টিনায়ও তিনি অর্জন করেছেন ‘দ্য নিউ ম্যারাডোনা’ নামের খ্যাতি। এই অর্জনটি বহন করা খুব কঠিন। কেননা তিনি বিশ্বমঞ্চে দেশকে ভালোভাবে এখনো প্রতিনিধিত্ব করতে পারেননি।
হ্যাঁ, মেসির গল্পটিও অনেক সেরা খেলোয়াড়ের মতো অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটত যদি না বার্সা তাকে তাদের দলে নিয়ে না নিত। মেসির জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন আর্জেন্টিনার সান্তা ফে নামের একটি প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর রোসারিওতে। তার পুরো নাম লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। অনেকে আদর করে ডাকেন ‘লিও মেসি’।
মেসির বাবা হোসে মেসি একটি স্টিলের কারখানার ম্যানেজার। তার ৪ সন্তানের তৃতীয় লিও। তার মা ফেলিয়া কুচিতিন একটি চুম্বক বানানোর কারখানায় কাজ করতেন। তারা বাবার দিক থেকে ইতালি ও স্পেন থেকে অভিবাসী। তাদের পরিবারটি ফুটবল অত্যন্ত ভালোবাসে। একেবারে ছোট থেকে ফুটবলের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী শিশু হিসেবে বেড়ে উঠেছেন মেসি। তিনি পড়ালেখার বয়স থেকেই ফুটবল খেলেন। তার বাবা একটি স্থানীয় ক্লাব গ্রান্দোলির কোচ ছিলেন। ছোট্ট মেসি সেই দলে খেলোয়াড় হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। বাবার অবিশ্বাস্য ফুটবল বোঝার ক্ষমতা এভাবেই বহন করেন মেসি।
পাঁচ বছর বয়সে সেখানে খেলা শুরু করেন মেসি। এরপর চলে যান তার দেশের “নিউওয়েল’স ওল্ড বয়েজে’। তখন থেকেই একজন প্রতিভাবান ফুটবলারের সব দক্ষতা, নৈপুণ্য ও যোগ্যতা প্রদর্শন করেন তিনি। যখন তার সামনে অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ার পড়ে আছে ঠিক সেসময় ১১ বছর বয়সে তার জীবন আটকে যায় মুত্যুর করাল থাবায়। বেড়ে উঠার হরমোনের একটি জটিল রোগে আক্রান্ত হন মেসি। ফলে জীবন বাঁচাতে সুদীর্ঘ ও খুব ভালো চিকিৎসার প্রয়োজন তার। মেসির চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য ছিল না তার গরিব বাবা-মায়ের। তবে তার ফুটবল যোগ্যতার মধ্যে কিছু অসাধারণ সম্ভাবনা দেখতে পেলেন, তার মেধায় নজর কাড়ল বার্সেলোনার। তাই তাকে নিয়ে তার মা-বাবা পাড়ি জমান বার্সেলোনায়।
বার্সা তার খেলা দেখে এতটাই সন্তুষ্ট হলো এবং অবিশ্বাস্য একটি শিশু ফুটবলারের দেখা পেল যে, তারা এই ছেলেটিকে বাঁচাতে রাজি হলেন। তারা মেসির সব চিকিৎসার খরচ বহন করবেন বলে জানিয়ে দিলেন। তবে এর প্রতিদানও পেতে শুরু করে বার্সা। ১৭ বছর বয়স থেকে বার্সেলোনার প্রথম দলে খেলা শুরু করেন মেসি। ১৮ বছর বয়স থেকে তিনি আর্জেন্টিনার অন্যতম প্রাণভোমরা। এমনকি বার্সেলোনা অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে ব্রাজিলের সুপারস্টার রোনালদিনহো এবং ক্যামেরুনের স্যামুয়েল ইতোকে আনার পরও নিজের প্রতিভা, যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণিত করে যান বার্সার এই ঘরের ছেলে।
রোনালদিনহো ও ইতোকে দলে ভেড়ানোর পরও বার্সেলোনা উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে তাদের সমাপ্তি টানতে বাধ্য হয়। কারণ উরুর ইনজুরি কারণে অকালে সেশনটি থামিয়ে দিতে হয় মেসিকে। হাড় ভেঙে যাওয়ায় পরের সেশনেরও প্রথম তিন মাস মাঠে নামতে পারেননি মেসি। তবে সেই ২০০৫-০৬ সেশনের পরের অংশে বার্সেলোনার প্রচারণা, ইউএফএ’র বিজয় রথ ও ফুটবলের প্রশস্তি চলতে লাগল তুঙ্গ বেগে। যখন মেসি ফিরেন পুরো ফর্মে। বার্সার ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সের খেলোয়াড় হিসেবে তিনি তাদের প্রচণ্ড ও হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন এল ক্লাসিকোতে। সেই সেশনের ফর্মের সেরা স্বাক্ষর রেখে মেসি শেষ ১৩ ম্যাচে করেন ১১ গোল।
২০০৭ সালে দুর্বল ডিফেন্স নিয়ে শিরোপা ধরে রাখতে মাঠে নামে বার্সা। আরও থমকে যায় রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে। ফলে ২০০৭-০৮ সেশনটি তাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে যায়। তবে বার্সাকে সবকিছু থেকে উতরে দিলেন মেসি। সবই করলেন তিনি। কাটান ইনজুরিমুক্ত আরেকটি মৌসুম। বনে গেলেন তারকাদের তারকা। তার ফর্মের কারণে কাতালান ক্লাবটি নিশ্চিত করে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল।
২০০৭-০৮ সেশন বার্সা ও মেসির জন্য হলো ‘এত কাছে তবুও এত দূরে’। ফাইনালে রিয়াদ মাদ্রিদের কাছে হেরে লা লিগার শিরোপা বঞ্চিত হয় তারা। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে তারা হেরে যায় আরেক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে। এরপর বার্সা শিবিরে যোগ দেন কোচ পেপ গার্দিওলা। তার অধীনে অনন্য হয়ে উঠেন মেসি। উঠে আসেন সেরা উচ্চতায়। ওই সেশনে গোল করেন ৩৮টি। বার্সা ত্রিমুকুটই জয় করে- দি স্প্যানিশ ক্লাব, লা লিগা এবং উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। তারা তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে তাদেরই ঘরের মাঠ বার্নাব্যুতে এল ক্লাসিকোতে হারায় ৬ গোল দিয়ে। তবে হজম করতে হয় একটি। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ম্যানচেস্টার হারিয়ে নেয় প্রতিশোধ। দুই ম্যাচেই বার্সেলোনার তুরুপের তাস লিওনেল মেসি করেন গোল।
বার্সেলোনার ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসিকে দেওয়া হয় স্পেনের নাগরিকত্ব। তবে তিনি জাতীয় দল হিসেবে বেছে নেন তার মায়ের দেশ আর্জেন্টিনাকে। তবে ইনজুরির কারণে ২০০৬ বিশ্বকাপ রাঙাতে না পারলেও এর প্রতিদান দেন পরের বছর দলকে কোপা আমেরিকার ফাইনালে তুলে।
মেসির জীবনের প্রেমের জন্মও আর্জেন্টিনার মেয়েতে। ১৪ বছর বয়সে মারাফেনা লেমোসের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান মেসি। কিশোরী লেমোস তখন উঠতি মডেল। ইনজুরি থেকে আরোগ্য লাভের সময় তাদের দু'জনের দেখা ও সম্পর্কের শুরু।
মেসি খুব নিয়মতান্ত্রিক। ফলে জীবননাশ করা কোনো ক্ষতির মধ্যে পড়েননি বিশ্বসেরা এই খেলোয়াড়। তবে তিনি ২০০৬ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগে ইংলিশ ক্লাব চেলসির বিপক্ষে ম্যাচে ভেঙে ফেলেন তার পা। মার্চে তিনি সেল্টিকের বিপক্ষে উরুতে চোট পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছাড়েন মাঠ। এরপর ৬ সপ্তাহ মাঠের বাইরে থাকতে হয় তাকে।
আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর দিয়াগো ম্যারাডোনার সঙ্গে লিওনেল মেসির তুলনা সব সময়ের। শুরুটা হয় ২০০৭ সালের এপ্রিলে কোপা দেল রে’র একটি ম্যাচে ফেতাফে এফসি’র বিপক্ষে ম্যারাডোনাময় একটি গোল করার পরই। ক্লাসিক ম্যারাডোনার মতো একের পর এক খেলোয়াড়কে কাটিয়ে মেসি একাই প্রায় অর্ধেক মাঠ বল নিয়ন্ত্রণে রাখেন। ৬ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে দারুণ নৈপুণ্যে করেন গোল। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার করা গোলটি স্মরণ করিয়ে দেন মেসি। এরপর থেকে মেসি যেভাবে দক্ষতা ও নৈপুণ্য দেখিয়ে গোল করতে থাকেন তাতে আর্জেন্টাইনদের বিশ্বাস, মেসি এখন ‘আর্জেন্টাইন ঈশ্বর’।
ওএফএস/এসজি