চোখের জলে রোনালদোর বিদায়
ক্যানভাসে আঁকা একটি ছবি
সে তো হাজার কথার প্রলেপ,
এক ফোঁটা চোখের জল,
সে তো বিদীর্ণ আত্মার সুদীর্ঘ বিলাপ-
কবিতার এই চরণগুলো যেন পর্তুগিজ যুবরাজ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর বিশ্বকাপ ফুটবলে নিজের বিদায়ী ম্যাচ শেষে তার শিশুর মতো অনবরত চোখের জলের কথাই জানান দিচ্ছে। যে কান্নার পেছনে লুকিয়ে আছে অব্যক্ত বেদনার হাজারো কথা। কবি বলেছেন-
এক ফোঁটা চোখের জল
কত কথা বলে-
গাঢ় সে অনুভূতি ব্যক্ত হলে শেষ হবে না একটি মহাকাব্য-
মরক্কোর কাছে হেরে পর্তুগালের বিদায় শুধু বিশ্বকাপ ফুটবল থেকেই হয়নি, সেই সঙ্গে এই সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার রোনালদোরও শেষ বিশ্বকাপ ছিল এটি। দলের বিদায়ে রোনালদোর এই কান্না, নাকি নিজের শেষ বিশ্বকাপ হওয়ায়। এই দুটি তো ছিলই সেই সঙ্গে ছিল বিদায় বেলায় রোনালদো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া, দলের হয়ে শুরু থেকে খেলতে না পারা, দলের জন্য পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখার সুযোগ না পাওয়া।
গ্রুপপর্বে বিষয়টি খুব একটা রেখাপাত না করলেও নকআউট পর্ব থেকে বিষয়টি খুবই সামনে চলে আসে। বিজয়ী দলের বুনো উল্লাসের বিপরীতে হেরে যাওয়া দলের বিষাদের চিহ্ন ফুটে উঠে সর্বত্র। আনন্দ বেদনার এরকম যুগপৎ দৃশ্য বিশ্বকাপ ফুটবলে অচেনা নয়। কিন্তু রোনালদোর কান্না ছিল আরও গভীরে। যে কান্নার অর্থ ছিল ভিন্ন।
নিজের শেষ বিশ্বকাপে রোনালদো চেয়েছিলেন জান-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে দেশকে বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দিতে। বেশ কয়েকবার ফিফা ব্যালেন ডি'অর জেতা, ক্লাব ফুটবলে অসংখ্য সাফল্য পাওয়ার পর রোনালদো ২০১৬ সালে দেশকে ইউরোর শিরোপা এনে দেন। বিদায় বেলায় এসে বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার জন্য একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা। সেভাবে যাত্রাও শুরু করেছিলেন ঘানার বিপক্ষে আসরে দেশের হয়ে প্রথম গোলটি করে। কিন্তু কোচ ফার্নান্দো সান্তোষ ৩৭ বছর বয়সী রোনালদোর উপর কেন যেন আস্থা রাখতে পারেননি। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে কোরিয়ার কাছে পর্তুগাল ২-১ গোলে হেরেছিল, সেই ম্যাচে কোচ তাকে ম্যাচের ৬৫ মিনিটে মাঠ থেকে তুলে নিয়ে আসেন। সেসময় খেলা ১-১ গোলে ড্র ছিল।
রোনালদো তাকে তুলে আনার বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। মাঠ ছেড়ে বের হয়ে আসার সময় মুখে আঙ্গুল দিয়ে কোচকে চুপ থাকার অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ করেছিলেন। বিষয়টি আবার কোচ সান্তোস ভালোভাবে নেননি। তখনই গণমাধ্যমে প্রচার হয়ে যায় নকআউট পর্বে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে রোনালদোকে সেরা একাদশে না খেলানোর। সেটার সত্যতা মিলে খেলার দিন। রোনালদোকে দেখা যায় সাইড বেঞ্চে। তাকে ছাড়াই পর্তুগাল ৬-১ গোলে এগিয়ে থাকা অবস্থায় রোনালদোকে মাঠে নামিয়ে ছিলেন ৭৩ মিনিটে। বদলি হিসেবে রোনালদোকে মাঠে নামানো তে অনেকেই ভেবেছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে রোনালদোকে শুরু থেকেই সেরা একাদশে দেখা যাবে।
সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে রোনালদোকে ছাড়াই বড় জয়ে কোচ সান্তোসকে হয়তো আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। যে কারণে মরক্কোর বিপক্ষেও রোনালদোকে সেরা একাদশে রাখেননি তিনি। কিন্তু এবার আর কোচ সফল হননি। ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় সান্তোস রোনালদোর শরণাপন্ন হন। মাঠে নামান ৫১তম মিনিটে। মাঠে নেমেই রোনালদো বেশ কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন গোলের জন্য। এমনকি ইনজুরি টাইমে মরক্কোর গোল পোস্ট লক্ষ্য করে শেষ শটটিও নিয়েছিলেন রোনালদো। কিন্তু মরক্কোর গোলরক্ষক তা অসম্ভব দৃঢ়তায় রক্ষা করে দেন। এই গোলটি হয়ে গেলে খেলায় সমতা আসত। তখন হয়তো রোনালদো সুযোগ পেতেন অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে কিছু একটা করার, সঙ্গে কোচ সান্তোসকেও একটা জবাব দেওয়া হয়ে যেত। কিন্তু সেই সুযোগ আর তিনি পাননি।
খেলার শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই মরক্কোর ফুটবলাররা যখন সেমিফাইনালে উঠার আনন্দে মাতোয়ারা, পর্তুগালের খেলোয়াড়রা তখন হতাশায় মাঠে কেউ বসে পড়েছেন, কেউ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন, কেউ বা শুয়ে পড়েছেন। রোনালদোর চোখে তখন জল। শিশুর মতো কাঁদছেন। মাঠে না থেকে সোজা হাঁটা ধরেন ড্রেসিংরুমের দিকে। টিভি ক্যামেরাও মরক্কোর খেলোয়াড়দের উল্লাস বাদ দিয়ে তখন রোনালদোর দিকে তাক করে এগুচ্ছে। মাথা নিচু করে রোনালদো অনবরত কেঁদে কেঁদে হেঁটে চলেছেন, সঙ্গে একজন নিরাপত্তারক্ষী। টিভি ক্যামেরা তাকে অনুসরণ করতে করতে ড্রেসিংরুমের কাছাকাছি পর্যন্ত চলে যায়। রোনালদোর এই কান্না তার অগণিত ভক্তদের অন্তরও ছুঁয়ে যায়। তাই রোনালদোর বিশ্বকাপের বিদায়টা হয়েছে বিষাদময়। যতদ্রুত সম্ভব তিনি শেষ ম্যাচটি ভুলে যেতে চাইবেন। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী রোনালদোর জন্য হবে তা স্বস্তির, মুক্তির। কারণ কষ্ট আর দুঃখকে বুকে লালন করতে কে চায়?
২০০৩ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর রোনালদো ১৮ বছর জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ১৯৬টি ম্যাচ। গোল করেছেন ১১৮টি। বিশ্বকাপে তার একটি হ্যাটট্রিকসহ গোলের সংখ্যা ৮টি। রোনালদো এরপর হয়তো পর্তুগালের হয়ে আরও ম্যাচ খেলতে পারেন। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলে একজন কিংবদন্তির বিদায় হলো অত্যন্ত বেদনাদায়কভাবে। এরকম অপ্রত্যাশিত বিদায় কেউই আশা করেননি। তবে রোনলদোর এমন কান্না ফিফার কর্তাদের নাড়া দিয়েছে। রোনালদোকে সম্মান জানাতে তার বিশ্বকাপে করা কয়েকটি গোলের মুহূর্ত নিয়ে ফিফা একটি ভিডিও পোস্ট করে।
এমপি/এসজি