কোরিয়াকে বিদায় করে শেষ আটে ব্রাজিল
গ্রুপ পর্বের প্রথম দুই ম্যাচে ভক্ত সমর্থকদের বারবার সাম্বা নৃত্য করার উপলক্ষ এনে দিয়ে শেষ ষোল নিশ্চিত করা ব্রাজিল শেষ ম্যাচে ক্যামেরুনের বিপক্ষে নিজেদের রিজার্ভ ব্রেঞ্চ পরীক্ষা করেছিল। সেই রিজার্ভ বেঞ্চেই ক্যামেরুনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তারপর স্রোতে বিপরীতে গিয়ে একটি গোল হজম করে ম্যাচ হারলেও তাতে দর্শক সমর্থকদের অন্তরে ন্যূনতম কোনো টেনশন বিরাজ করেনি।
কারণ তারা জানতেন নকআউট পর্বে আবার সেরা খেলোয়াড়রা ফিরবেন। ব্রাজিল ফিরবে নিজেদের ছন্দে। আর নেইমার ফিরলেতো কথাই নেই। কোরিয়ার বিপক্ষে পুরো শক্তির ব্রাজিল ফিরে নেইমারকে নিয়ে। দুই ম্যাচ পর নেইমারকে ফিরে পেয়ে ব্রাজিল যেন আরও ছন্দময় হয়ে উঠে। সাম্বা নৃত্যের তালে তালে দর্শকদের বিমোহিত করে রাখে।
ছন্দময় কবিতার মতো খেলা উপহার দিয়ে কোরিয়াকে কোনঠাসা করে ৪-১ গোলে পরাজিত করে। প্রথমার্ধেই তারা এগিয়ে ছিল ৪-০ গোলে। গোল চারটি আসে ভিনিসিয়াস জুনিয়র, নেইমার, রিচার্লিসন ও লুকাসের পা থেকে। দক্ষিণ কোরিয়ার হয়ে একটি গোল পরিশোধ করেন পাক সিইউং। শেষ ষোলতে ব্রাজিলই ছয় ম্যাচের মাঝে সবচেয়ে বেশি গোল দিয়েছে। শেষ আটে ১০ ডিসেম্বর তাদের প্রতিপক্ষ গতবারের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া।
আগের ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার কাছে জাপান টাইব্রেকারে হেরে গেলে এশিয়ার শেষ প্রতিনিধি ছিল দক্ষিণ কোরিয়া। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে জাপানের জয় আশা অনেকে করলেও ব্রাজিলের বিপক্ষে কোরিয়াকে নিয়ে আশাবাদী লোকের সংখ্যা ছিল না বললেই চলে। তাই এমন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কোরিয়া কিছুটা রক্ষাণাত্বক পদ্ধতি অবলম্বন করে। ৪-৩-৩ পদ্ধতিতে মাঠে নামে। ব্রাজিল ছিল আক্রণাত্বক । তারা খেলতে নামে ৪-২-৩-১ পদ্ধতিতে। কিন্তু ব্রাজিলের আক্রমণের ঢেউয়ে কোরিয়ার রক্ষণদূর্গ বানের পানির মতো ভেসে যায়। প্রথমার্ধেই তারা হজম করে চার চারটি গোল।
প্রথমর্ধে ব্রাজিল যেভাবে খেলে চার গোল আদায় করে নেয়, তাতে করে দ্বিতীয়ার্ধে তারা কোনো গোল না পাওয়া ছিল অবাক করার মতো। এ সময় তারা নিজেদের ছন্দ ধরে রাখলেও কোরিয়া দারুণভাবে খেলায় ফিরে আসে।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হতেই কোরিয়া যেভাবে আক্রমণ শুরু করে তাতে মনেই হবে না যে তারা প্রথমর্ধে চার গোল হজম করেছিল। প্রথম আক্রমণ থেকেই তারা গোল পেয়ে যাচ্ছিল। বাম প্রান্ত দিয়ে বক্সে ডুকে সন হিউং গোলরক্ষক আলিসনকে একা পেয়েও গোল করতে পারেননি। তার নেওয়া শট আলিসন কর্নার করে রক্ষা করেন। এই শুরুটা এই অর্ধে ধরে রাখে। এ সময় তারা ব্রাজিলকে কোনো গোল করতে দেয়নি। নিজেরা একটি গোল পরিশোধ করে। আবার ব্রাজিলের গোলরক্ষক আলিসনের দৃঢ়তায় একাধিক গোল বঞ্চিতও হয়। এতো ভালো খেলার পরও কোচ তিতে তাকে ৮০ মিনিটের সময় তুলে নেন। এর আগে তিনি একে একে তুলে নেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র, নেইমারকেও। তিনি পাঁচটি পরিবর্তন আনেন। কোরিয়ার কোচও পাঁচ পরিবর্তন আনেন। তাদের গোলটিও আসে বদলি খেলোয়াড় পাক সিইউংয়ের পা থেকে।
দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিলের তুলনায় কোরিয়ার আক্রমণের ধার ছিল বেশি। ব্রাজিলও একাধিক সুযোগ তৈরি করেছিল কিন্তু তারাও আর সফলতার মুখ দেখেনি কোরিয়ার গোলরক্ষক কিম সিউংয়ে কারণে।
দ্বিতীয়ার্ধে কোরিয়ার প্রথম আক্রমণ ঠেকিয়ে ব্রাজিল আবার ফিরে নিজেদের ছন্দে। ৫৩ মিনিটেই তারা পেয়ে যেতে পারতো পঞ্চম গোল। বক্সের ভেতর কোরিয়ার তিনজন খেলোয়াড়ের ফাঁক দিয়ে রাফিনহার বাম পায়ের প্লেসিং শট গোলরক্ষক কিম সিউং মাটিতে শুয়ে পড়ে কোন রকমে কর্নার করে রক্ষা করেন। ৬১ মিনিটে নেইমারের কাছ থেকে বল পেয়ে একইভাবে রাফিনহার আরেকটি শট আটকে দেন গোলরক্ষক। ৬৮ মিনিটে কোরিয়ার হোয়ানহি চেংয়ের শট আলিসন ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করেন। ৭৭ মিনিটে কোরিয়া একটি গোল পরিশোধ করে। ফ্রি কিক থেকে ব্রাজিলের রক্ষণের একজন খেলোয়াড় হেড করে বল ক্লিয়ার করলেও বিপদমুক্ত হতে পারেনি। বক্সের বাইরে সেই বল পেয়ে যান বদলি খেলোয়াড় পাক সিইউং। তার বাম পায়ের বলি শট ব্রাজিলের জাল কাঁপিয়ে তুলে। পরের মিনিটে কোরিয়ার আরেকটি শট আলিসন আগের মতো ঠেকিয়ে দেন।
এর আগে প্রথমার্ধে খেলা শুরু হতে না হতেই ব্রাজিল একটি নয়, দুইটি গোল পেয়ে যায়। সাত মিনিটে ভিনিসিয়াস জুনিয়রের গোলটি ছিল শেষ ষোলতে দ্রুততম। ডান প্রান্ত থেকে রাফিনেহোরপাস থেকে নেইমারের পা ছুঁয়াতে ব্যর্থ হলেও ফাকায় বল পেয়ে যান ভিনিসিয়াস জুনিয়র। দেখ-শুনে দ্বিতীয় বার দিয়ে তিনি গোল করেন। প্রথম আক্রমণেই ব্রাজিল সফলতার মুখ দেখে। ১১ মিনিটে পেনাল্টি থেকে নেইমার গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে নেন। বক্সের মধ্যে রিচার্লিসনকে ফাউল করলে ব্রাজিল পেনাল্টি পেয়েছিল।
শুরু থেকেই ব্রাজিল চেপে ধরেছিল কোরিয়াকে। একের পর এক আক্রমণ করে কোরিয়াকে কোনঠাসা করে রাখে। সেই চাপে কোরিয়া দুই গোল হজম করার পর প্রথম আ্ক্রমণে যায় ১৬ মিনিটে। হোয়াং হি চেনের বক্সের উপর থেকে ডান পায়ের তীব্র শট ব্রাজিলের গোলরক্ষক আলিসন পাঞ্চ করে কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ব্রাজিলের সামনে তারা বেশি সময় টেকতে পারেনি। পাল্টা আক্রমণে যায়। আবার ব্যস্ত করে তুলে কোরিয়ার রক্ষণ। সাফল্যও পায় ২৮ মিনিটে। এবার গোলদাতা প্রথম ম্যাচে সার্বিয়ার বিপক্ষে চলতি আসরের সেরা ও দৃষ্টিনন্দন গোল করা রিচার্লিসন।
এই গোলটিতেও ছিল মুন্সিয়ানা ও দৃষ্টিনন্দন ছাপ। তিনবার মাথার উপর বল রেখে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বল পা দিয়ে রিসিভ করে থিয়াগো সিলভাকে দিয়ে নিজে বক্সের ভেতর ফাঁকায় জায়গা করে নিলে সিলভা তার দিকে বল বাড়িয়ে দেন। রিচার্লিসন সেই বল ধরে বাম পায়ে প্লেসিং শটে চলতি আসরে নিজের তৃতীয় গোল তুলে নেন। ৩৫ মিনিটে ছিল আরেকটি সাম্বা নৃত্য উদযাপনের উপলক্ষ। রিচার্লিসন ও নেইমার মাঝ মাঠ থেকে বল আদান-প্রদান করে নিয়ে বক্সে ডুকে নেইমার বামপ্রান্ত দিয়ে ভিনিসিয়াসকে দিলে তিনি বক্সে ক্রস করে লুকাস পাকুয়েটাকে উদ্দেশ করে। লুকাস ডান পায়ের জোড়ালো শটে গোলের খাতায় নাম লেখান।
৪৫ মিনিটে রাফিনহা গোলের তালিকায় নাম লেখাতে পারতেন। কিন্তু তিনি বাম পা দিয়ে গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে জালে প্রবেশ করাতে গিয়ে তার হাতে তুলে দেন। প্রথমার্ধের ইনিজুরি টাইমের তৃতীয় মিনিটে রিচার্লিসন বল নিয়ে এককভাবে ডুকে ডান প্রান্ত দিয়ে গোল করার চেষ্টা করলে গেোলরক্ষক কিম সিউওংয়ের পা লেগে প্রতিহত হয়। সেই বল সামনে থাকা নেইমারের কাছে গেলে তিনি হাটু দিয়ে গোল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বল সাইডবার দিয়ে বাইরে চলে যায়।
এমপি/আরএ/