মুন্নাকে রাফ চার্জ করে ধমক খেয়েছিলেন নবিন
বাংলাদেশের ফুটবলের জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বী। আবাহনী-মোহমেডানের ম্যাচ মানেই দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়া। উত্তেজনায় টুইটুম্বর। একই পরিবারে এক ভাই আবাহনীর সমর্থক হলে আরেক ভাই মোহামেডানের সমর্থক। কিন্তু মোহামেডান আবাহনীর খেলার দিন ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক তখন আড়ালে পড়ে যায়। সব ছাপিয়ে নিজেদের প্রিয় দলই মূখ্য। প্রিয় দলকে নিয়ে এক ভাই আরেক ভাইকে কটাক্ষ করতে কোনও ছাড় নেই। সেই সময়ে একজন কিশোরের, একজন তরুণের স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হওয়া। আবাহনী কিংবা মোহামেডানে খেলা। মোহামেডান-আবাহনীর জনপ্রিয়তার ঢেউ এমনই উত্তাল ছিল যে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন তখন তাদের কাছে প্রাধান্য পেত না। কিন্তু চাইলেই তো আর এই দুই দলে খেলা সম্ভব হয় না। তাই অনেকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে খেলে দুধের স্বাধ ঘোলে মেঠাতে। এমনই একজন ফুটবলার ছিলেন নবিন রহমান। নবিন নামেই ফুটবল অঙ্গনে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তিনি।
১৯৮৪ সালে পাইনিয়ার ফুটবল লিগে কলাবাগান ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেন। পরের বছর দ্বিতীয় বিভাগে ইস্ট বেঙ্গলে খেলেন। সেই ক্লাবে ছিলেন জাতীয় দলের হয়ে খেলা অধিনায়ক জুয়েল রানাও। এরপর ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে আত্মপ্রকাশ তার। তারপর খেলেন ফরাশগঞ্জ ক্লাবে।
ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে খেলার সময়ই নবিন আবাহনীর বিপক্ষে একটি ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন। তিনি ছিলেন আবাহনীরই সমর্থক। মাত্র খেলা শুরু করেছেন। উদীয়মান। স্বপ্ন দেখছেন আবাহনীর আকাশি-হলুদ জার্সি পড়ে মাঠে নামবেন। তার আগেই চলে আসে আবাহনীর প্রতিপক্ষ হয়ে মাঠে নামার। মিরপুরে ধানমন্ডির হয়ে আবাহনীর বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন। তখন দেশ কাঁপানো ফুটবলার মোনেম মুন্না। রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হলেও মুন্না মাঝে মাঝে ওভারল্যাপ করে উপরে উঠে যেতেন। সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণ করে নবিন বলেন, ‘একবার মুন্না ভাইকে রাফ চার্জ করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, এই তুই সাবধানে খেলিস কিন্তু। পাটা ভাইঙ্গালামু। তুই ওল্টা-পার্টা চার্জ করস। এই স্মৃতি আমাকে খুবই আবেগ আপ্লুত করে তুলে। মুন্না ভাইতো এখন আর বেঁচে নেই।‘
মোহামেডানের বিপক্ষে খেলার সেই রকম অভিজ্ঞতা নেই। কারণ তিনি যখন উদীয়মান তখনই পায়ে ব্যাথা পেয়ে খেলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
নবিন নিজের ফুটবল জীবনের ইতি টানার ঘটনা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি মাত্র খেলা শুরু করেছি। চোখে অনেক স্বপ্ন। খুব বেশি দূরে যেতে পারেনি। পায়ে ব্যাথা পেলাম। আর মাঠে ফিরতে পারলাম না। পরে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে চলে আসি অস্ট্রেলিয়াতে। এখানে ইনশাল্লাহ ভালো আছি। খেলাধুলা করি না। তবে মাঝে মাঝে টুর্নামেন্ট হলে খেলি। ফুটবলকে আমি খুব মিস করি। আমার অন্তরে ফুটবল। খুব বেশি ভালোবাসি ফুটবলকে।’
নবিন খেলা শিখেছিলেন ফুটবলার গড়ার কারিগর আলী ইমামের কাছে। নামকরা অনেক ফুটবলার তখন ছিলেন আলী ইমামের ছাত্র। ফুটবলের পাশাপাশি তিনি নির্মাণ স্কুল ক্রিকেটও খেলছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাহমুদ সুজন, সেলিম শাহেদেদের সঙ্গে।
প্রবাসী হলেও দেশের ফুটবলের খবরাখবর সব সময় রাখেন নবিন। দেশে যে সকল বন্ধু, ছোট ভাই-বড় ভাই আছেন সেই ছোট মুন্না, আলমগীর, আরমান, আরিফ, লিটন ( ব্রাদার্স)তাদের কাছ থেকে তিনি ফুটবলের খবর পেয়ে থাকেন। ফুটবলের এখন জনপ্রিয়তা নেই। এটি তাকে কষ্ট দেয়। অস্ট্রেলিয়াতে যারা যখন জানে তিনি দেশে ফুটবল খেলতেন তখন অনেকেই বিশেষ করে সিনিয়ররা নবীনের কাছে জানতে চান তিনি কোথায় খেলেছেন, কোন ক্লাবে খেলেছেন। তখন বেশি সম্মানবোধ করে থাকেন তিনি। অস্ট্রেলিয়াতে বসবাসরত জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার মাহবুবুর রহমান সেলিমের সঙ্গে তার খেলা নিয়ে আলোচনা হয়। দুজনেই ভালো বন্ধু।
ফুটবলার নবিনকে দেশের ক্রিকেটের সাফল্য গর্বিত করে। অস্ট্রেলিয়াতে খেলা হলে তিনি ছুটে যান মাঠে স্বপরিবারে। এবারও তাই করেছেন। তিনি বলেন, ‘ ক্রিকেটের সাফল্য আমাকে অনেক গর্বিত করে। আমাদের দেশকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে। আমি ক্রিকেট খুব ভালোবাসি।আমাদের গর্ব করার মতো এই ক্রিকেটই আছে। ক্রিকেটে ডিফারেন্ট স্টোরি।’
অস্ট্রেলিয়ানরা তাদের মূল ভেন্যুগুলোতে বাংলাদেশকে খেলার সুযোগ না দেওয়াতে নবিনের কন্ঠে ঝড়েছে আক্ষেপ। তিনি আশা করেন, প্রবাসী বাংলাদেশি দর্শকদের কথা ভেবে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড বাংলাদেশের খেলাগুলো তাদের মূল ভেন্যুগুলোতে দিবে।
তিনি বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ানরা বাংলাদেশ দলকে সব সময় খেলার সুযোগ দেয় না। দিলেও হয় ডারউইন না হয় কেয়ানর্সে খেলা দেয়। সেখানে বাঙালি নেই বললেই চলে। কিন্তু এখানে খেলা দিলে কি পরিমাণ বাঙালি দর্শক হয় তাতো সবাই দেখছেনই। তাই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের উচিত হবে বাংলাদেশের খেলাগুলো, যাতে সিডনি, মেলবোর্ন, অ্যাডিলেডের মতো যেখানে বাংলাদেশের মানুষের বসবাস বেশি সেই সব জায়গাতে খেলার সুযোগ দেওয়া।’
এমপি/এসআইএইচ