সিলেটের অবাক করা ব্যাটিংয়ে স্টেডিয়ামে পিনপতন নীরবতা!
বিপিএলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থেকে নিজেদের মাটিতে খেলতে নামবে সিলেট। এ নিয়ে সিলেটবাসীর মাঝে রাজ্যের উচ্ছ্বাস। যারা টিকিট পেয়েছেন তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে সদল-বলে গিয়েছেন খেলা দেখতে। যারা টিকিট সংগ্রহ করতে পারেননি, তারা ভিন্ন পন্থায় চেষ্টা করছেন স্টেডিয়ামে ঢোকার। সর্বত্রই একটা উৎসবের আমেজ। এরকম উৎসবমুখর আমেজেই টস জিততে পারেননি মাশরাফি বিন মর্তুজা। কিন্তু তাকে ব্যাটিংয়ে পাঠান রংপুর রাইডার্সের অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান।
সিলেট আগে ব্যাট করবে জেনে দর্শকদের মাঝে আরেক দফা করতালি উঠে। কিন্তু শুরুটা ভালো হয়নি। দ্বিতীয় ওভারেই ভাঙন ধরে উদ্বোধনী জুটিতে। আগের ম্যাচে বরিশালের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওভারেই সিলেট হারিয়েছিল ৩ উইকেট। এবার ১ উইকেট। এ আর কী? এটা হতেই পারে। পরের ওভারে নেই আরও ১ উইকেট। রান ২ উইকেটে ১২। এটাও সমস্যা না। কারণ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে বরিশালের বিপক্ষে ম্যাচটি। ২ ওভারে ১৫ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর সেখান থেকে নাজমুল হোসেন শান্ত ও টম মুরিসের দৃঢ়তায় সিলেট ৫ উইকেটে ১৭৩ রান করে ম্যাচ জিতেছিল ২ রানে। এবারও কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে যাবে? কিন্তু না এবার আর কেউ দাঁড়াতে পারেননি। নামে ভয়াবহ ধস। যে ধসে চরমভাবে বিধস্ত হয় সিলেট। সংগ্রহ করে ৯ উইকেটে ৯২। এবারের বিপিএলে এটি দ্বিতীয় সর্বনিম্ন রান। সর্বনিম্ন রান খুলনা টাইগার্সের। ঢাকা ডমিনেটরসের বিপক্ষে তারা করেছিল ৮৪ রান।
সিলেটের দুই ওপেনার ব্যাট করতে নামার সময় যেখানে ছিল বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার, সেখানে মুহূর্তেই নেমে আসে রাজ্যের নীরবতা। দেখে মনে হয় মৃত্যুপুরী। স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক। কিন্তু সবাই নিশ্চুপ! সিলেটে প্রচণ্ড শীতে রংপুরের বোলাররা উত্তাপ ছড়ালেও সিলেটবাসীর মাঝে বিরাজ করে মাইনাস তাপমাত্রা। যেন বরফে ঢাকা পড়ে আছেন তারা।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে হাই স্কোরিং ম্যাচ হওয়ার পর সিলেটেও রান ফোয়ারা হবে কি না? কিংবা সিলেটের উইকেট কেমন হবে? এ নিয়ে আগের দিন বৃহস্পতিবার নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছে। কিন্তু সেভাবে কেউ কিছু বলেননি। শুধু উদাহরণ হিসেবে এই মাঠে অনুষ্ঠিত আগের কয়েকটি খেলাকে সামনে নিয়ে আসা হয়। যেগুলো ছিল হাই স্কোরিং। তবে তা ছিল লংগার ভার্সন ম্যাচ। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তা বজায় থাকবে কি না তা নিয়ে ছিল দোদুল্যমানতা। শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠে বোলারদের রাজত্বে ভরা।
বোলারদের রাজত্ব এমনই প্রকটভাবে ফুঠে উঠে যে, আসরে সিলেটের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন গুঁড়িয়ে যায়। পেস আর স্পিনের মিলনমেলায় পরিণত হয় উইকেট। যাদের সামনে দাঁড়িয়ে সিলেট ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে সংগ্রহ করে ৫ উইকেট হারিয়ে মাত্র ১৬ রান। ক্রিজে সিলেটের ব্যাটসম্যানদের অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে দেখে মনে হয়েছে প্রতি বলে বলেই তারা উইকেট হারাবে!
বরিশালের বিপক্ষে আগের ম্যাচে বিপর্যয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে ভালো ব্যাটিং করায় টম মুরিসকে এবার নাজমুলের সঙ্গে ইনিংসের উদ্বোধন করতে পাঠানো হয়। কিন্তু তাকে দিয়েই শুরু হয় সিলেটের পতনের ডাক। আজমতউল্লাহ ওমজাইয়ের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরে আসার পর পরের ওভারে নাজমুল হোসেন শান্তও ফিরে যান শেখ মেহেদি হাসানের শিকার হয়ে। ৯ বলে ৯ রান করলেও ইনিংসে একটি ছক্কা থাকায় আজও ভালো কিছু করার ইঙ্গিত ছিল। বরিশাল বিপর্যয়ে দুই ত্রাণকর্তা শুরুতেই আউট হয়ে যাওয়ায় পরে আর কোনো ব্যাটসম্যান দাঁড়াতেই পারেননি। শুরু হয় আসা-যাওয়ার মিছিল। মিছিলে একে একে শামিল হন তৌহিদ হৃদয় ০, মুশফিকুর রহিম ০, জাকির হাসান ০, থিসারা পেরারা ৩, ইমাদ ওয়াসিম ১। ফলে সিলেটের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ৮.৪ ওভারে মাত্র ১৮ রান।
এসময় সিলেট নিজেদের মাঠে বিপিএলের ইতিহাসে সর্বনিম্ন রানে অলআউট হওয়ার লজ্জার সামনে পড়ে। বিপিএলে সর্বনিম্ন রান ৪৪। ২০১৬ সালে মিরপুরে এই রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে খুলনা টাইটান্স ১০.৪ ওভারে ৪৪ রানে অলআউট হয়েছিল। কিন্তু সিলেটকে সে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করেন তানজিম হাসান সাকিব ও কাপ্তান মাশরাফি। দুইজন পাল উড়িয়ে ধরেন। রংপুরের বোলারদের গোলা সামলে তারা ধীরে ধীরে দলের রান বাড়িয়ে নিতে থাকেন। তাদের এই রান দলের ভীত মজবুত করার মতো ছিল না। কিন্তু সর্বনিম্ন রানের যে ইনিংসগুলো আছে যেমন ৪৪ রানের পর ৫৮, ৫৯, ৬৩, ৬৭, ৬৭, ৬৮, ৬৮, ৭২, ৭৪, ৭৬, ৭৯, ৭৯, ৮২, ৮৪, ৮৪, ৮৬, ৮৭-এগুলো তারা অতিক্রম করে যান। দুইজন অষ্টম উইকেট জুটিতে ব্যাটিং করার সময় পিনপতন নীরবতা ভেঙে সিলেটের দর্শকরা আবার আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেন। মাশরাফি ও তানজিম ২টি করে ছক্কা উপহার দেন। তানজিমের ২ ছক্কার সঙ্গে ছিল ৫টি চারও। এসময় দর্শকরা বেশ উল্লাস করতে থাকেন।
মাশরাফি ও তানজিম দুইজন ৭ ওভারে যোগ করেন ৪৮ রান। ২১ বলে ২ ছক্কায় ২১ রান করে মাশরাফি হাসান মাহমুদের শিকার হলে ভাঙে জুটি। অপরপ্রান্তে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম সদস্য সিলেটেরই সন্তান তানজিম হাসান সাকিব ছিলেন অবিচল। লড়াই করে যান একা। মোহাম্মদ আমিরকে নিয়ে নবম উইকেট জুটিতে ১৯ রান যোগ করে তিনি আউট হয়ে যান। তাকেও আউট করেন হাসান মাহমুদ। আউট হওয়ার আগে ২ ছক্কা ও ৫ চারে ৩৬ বলে করেন সর্বোচ্চ ৪১ রান।
মূলত মাশরাফি ও তানজিমের কারণে সিলেট যেখানে অল্প রানেই অলআউট হয়ে যাওয়ার কথা। সেখানে অলআউট না হয়ে ৯ উইকেটে করে ৯২ রান। ৮.৪ ওভারে ১৮ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর বাকি ১১.২ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে যোগ করে ৭৪ রান।
রংপুরের পক্ষে হাসান মাহমুদ ১২ ও আজমতউল্লাহ ওমরজাই ১৭ রানে ৩টি, মেহেদি হাসান ১২ রানে ২টি ও হারিস রউফ ১৯ রানে নেন ১ উইকটে।
এমপি/এসজি