মেসির বিশ্বজয়, বাংলাদেশের সাফ জয়
উপমহাদেশের বিশ্বকাপ বলা হয়ে থাকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপকে। ২০০৩ সালে প্রথম ও সর্বশেষ হয়েছিল চ্যাম্পিয়ন। এরপর ২০০৫ সালে ফাইনালে উঠেছিল। এরপর আর সেমিতেই যেতে পারেনি। সর্বত্রই হতাশা। সেই হতাশা দূর করে দেন বাংলার বাঘিনীরা।
নেপালের কাঠমান্ডুতে মেয়েদের ষষ্ঠ আসরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়। ফাইনালে তারা স্বাগতিক নেপালকে হারিয়েছিল ৩-১ গোলে। ১৩ মিনিটে সামসুন্নাহার জুনিয়রের গোলে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। পরের দুইটি গোল ছিল অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের। নেপালের হয়ে একমাত্র গোলটি করেছিলেন অনিতা।
লিগ পর্বে মালদ্বীপকে ৩-০ গোলে হারিয়ে সাবিনাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরের ম্যাচে সাবিনার হ্যাটট্রিকে পাকিস্তানকে বিধ্বস্ত করেছিল ৬-০ গোলে। শেষ ম্যাচে চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে বধ করে ৩-০ গোলে। ‘এ’ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ সেমিতে পায় ভুটানকে। আবারও সাবিনা হ্যাটট্রিক করেন। বাংলাদেশ জয় পায় ৮-০ গোলের বড় ব্যবধানে।
দুইটি হ্যাটট্রিকসহ টুর্নামেন্টে ৮ গোল করে সাবিনা সর্বোচ্চ গোলদাতার পাশাপাশি সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতে নেন। সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার জেতেন রূপমা চাকমা।
এই জয়ে বাংলাদেশে আনন্দের ঢেউ বহে যায়। বীরকন্যাদের বরণ করে নিতে মানুষ ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন। বিমানবন্দরে জনতার ঢল নামে। ছাদ খোলা বাসে করে মেয়েদের হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মতিঝিল বাফুফে ভবনে। মেয়েরা রাস্তা অতিক্রমের সময় দুই পাশে দাঁড়িয়ে জনতা অভিবাদন জানান। বিভিন্ন ভবন থেকেও মানুষজন সাবিনা-সানজিদাদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানানো হয়। ফুটবলের সাফল্যে এমন গনজাগরণ আগে কখনো দেখা যায়নি।
সাবিনাদের এমন সাফল্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে লাখ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এর পাশাপাশি শহীদ মিনারে সংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় সংবর্ধনা। এ ছাড়া নিজ নিজ জেলা শহরেও ফুটবলাররা সংবর্ধনায় সিক্ত হন।
হতাশার মাঝেই জামাল ভূঁইয়ারা
মেয়েদের সাফল্যের বিপরীতে ছেলেরা ছিলেন ব্যর্থতার জালে আবদ্ধ। এ বছর তারা পাঁচটি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলা ছাড়াও এএফসি বাছাইপর্বের তৃতীয় রাউন্ডের খেলায় অংশ নেয়। ফ্রেন্ডলি ম্যাচে একটিতে জয় পায়। একটি ড্র করে। হার ছিল বাকি তিনটিতে। এএফসি কাপে দুইটিতে হেরে একটিতে ড্র করতে পেরেছিল।
শুরুটা করেছিল ফ্রেন্ডলি ম্যাচে দিয়ে। ২৪ মার্চ মালেতে মালদ্বীপের কাছে হেরেছিল ২-০ গোলে। পরে ২৯ মার্চ সিলেটে মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করেছিল। ১ জুন ইন্দোনেশিয়ার মাঠে গোলশূন্য ড্র করে। এরপর শেষ দুইটি ম্যাচ খেলে সেপ্টেম্বরের ২২ ও ২৭ তারিখ। কম্বোডিয়াকে তাদের মাঠে রাকিবের গোলে ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাদেশ গিয়েছিল নেপালে। নেপালের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে তখন তরতাজা ছিল সাফ নারী আসরে এই নেপালকেই ৩-১ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়া। সবাই আশা করেছিলেন বাংলাদেশ অন্তত এই ম্যাচ জিতবে। কিন্তু হেরে যায় সেই ৩-১ ব্যবধানে। বাংলাদেশের হয়ে গোল করেন সাজ্জাদ।
এ বছর বাংলাদেশ এএফসি তৃতীয় রাউন্ডের বাছাইপর্বে অংশ নিয়ে হতাশজনক ফলাফল করে। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আসতে তুর্কিমেনিস্তানের কাছে ২-১ গোলে হেরে আসর শুরু করে। বাংলাদেশের হয়ে গোল করেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম। পরের ম্যাচে মালয়েশিয়ার কাছে হেরেছিল ৪-১ গোলে। এই ম্যাচেও বাংলাদেশের হয়ে গোল করেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম। বাহরাইনের কাছে তৃতীয় ম্যাচ হার মেনেছিল ২-০ গোলে।
জেবিয়ার কাবরেরার দায়িত্ব গ্রহণ
জামাল ভুইয়াদের কোচ হিসেবে ২০১৮ সালে দায়িত্ব নেওয়া ব্রিটিশ জেমি ডে এ বছর দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তার জায়গায় দায়িত্ব দেয়া হয় স্প্যানিশ জেবিয়ার কাবরেরাকে। জেমিডের কোচিংয়ে বাংলাদেশ ৩১ ম্যাচ খেলে জয় পায় ১০টিতে। হেরেছিল ১৬টিতে। ড্র করতে পেরেছিল ৫টিতে। ৩২টি গোল দিয়ে ৩৯টি গোল হজম করেছিল। কাবরেরার কোচিংয়ে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৮টি ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছে মাত্র একটিতে। ২টিতে ড্র করে হেরেছে ৫টিতে। ৪ গোল দিয়ে হজম করেছে ১৩ গোল।
মেসির বিশ্বজয়
‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ কিংবা ‘ব্যর্থতাই সাফল্যের চাবিকাঠি’ বাংলা এই প্রবাদ বাক্যগুলো যেন মেসির জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শুরু করেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে নিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ চুড়ায়। জায়গা করে নিয়েছেন সর্বকালের সেরা ফুটবলাদের তালিকায়। সাফল্য তার পায়ে এসে গড়াগড়ি করেছে। কিন্তু সেখানে ছিল না বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা। যে শিরোপার জন্য মুখিয়ে থাকেন একজন ফুটবলার। তার দেশ। সবাই সে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন না। কিন্তু মেসি এবং তার দেশ আর্জেন্টিনার সেই যোগ্যতা ছিল। কিন্তু একে একে চারটি বিশ্বকাপ খেললেও মেসির শিরোপা জেতা হয়নি। কাতার বিশ্বকাপ ছিল মেসির । গোটা বিশ্ব তাকিয়ে ছিল যাতে করে মেসি এবার শিরোপা জিতেন। শেষ পর্যন্ত শিরোপার মসনদে বসেন মেসি। টানটান উত্তেজনার ইতিহাস সৃষ্টিকারি এক ফাইনাল উপহার দেন বিশ্বকে। প্রথমে মেসি আর ডি মারিয়ার গোলে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল। কিন্তু এমবাপ্পের তোপে খেলায় সমতা আসে ২-২ গোলে। পরে মেসি আবার গোলে করে দলকে এগিয়ে নিলে এমবাপ্পের হ্যাটট্রিকে আবার খেলায় আসে সমতা। এরপর টাইব্রেকারে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে ৪-১ গোলে হারিয়ে চির আরাধ্য শিরোপা জয়ে মেতে উঠেন মেসি ও আর্জেন্টিনার ফুটবলার। সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে ছটিয়ে থাকা কোটি কোটি দর্শকরা। বাংলাদেশে রাত জেগে চলে হৈহুল্লুড়।
শিরোপা জয়ের পথে কিন্তু প্রথম ম্যাচেই হোঁচট খায় আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে সৌদি আরবের কাছে হেরে। চার বার খেলে শিরোপা জিততে না পারা আর প্রথম ম্যাচের ব্যর্থতা মেসিকে যেন কাপ জয়ে আরও বেশি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তুলেছিল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একটি করে ম্যাচ এসেছে আর প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে এগিয়ে গেছেন শিরোপার দিকে। মেসি হয়ে উঠেন আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য। প্রতিটি ম্যাচেই হয় তিনি গোল করেছেন, না হয় গোল করিয়েছেন। এমনি করে গ্রুপ পর্বে মেক্সিকো ও পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়ে শেষ ষোলতে উঠে আসে আর্জেন্টিনা। এখানে প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। এখানেও মেসি ঝলক। আর্জেন্টিনা জেতে ২-০ গোলে।
শেষ আটে প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস। বাঁধা হতে পারেনি তারাও। মলিনা ও মেসির গোলে ২-০ ব্যবধানে আর্জেন্টিনা এগিয়ে থাকার পরও নেদারল্যান্ডস সমতা আনে। পরে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে গোলরক্ষক ইমি মার্টিনেজের দৃঢ়তায় আর্জেন্টিনা জয় পায় ৪-৩ গোলে। সেমিতে বাঁধা হতে চেয়েছিল বর্তমান রানার্সআপ। কিন্তু মেসি ঝলকে তারাও বালির বাঁধের মতো ভেসে যায় ৩-০ গোলে হেরে। মেসি করেন এক গোল, আলভারেজের গোল ছিল দুইটি। তারপর সেই ঐতিহাসিক ফাইনাল।কাতার বিশ্বকাপটি হয়ে উঠেছিল মেসিময়। শিরোপা জেতার পাশাপাশি জিতে নেন গোল্ডেন বলও। একটি গোল কম হওয়াতে জিততে পারেননি গোল্ডেন বুটও। তার গোল ছিল ৭টি। ৮ গোল করে গোল্ডেন বুট জিতে নেন এমবাপ্পে।
ইংল্যান্ডের মেয়েদের ইউরো জয়
ফুটবলে ইংল্যান্ডের ছেলেরা না পারলেও, মেয়েরা ইউরো শিরোপা জিতে নিয়েছে। ২০২০ সালে ছেলেদের ইউরো ফাইনালে ইংল্যান্ড টাইব্রেকারে হেরেছিল ইতালির কাছে ৩-২ গোলে। ২০২২ সালে এসে মেয়েরা ইংরেজ সমর্থকদের আর হতাশ করেননি। ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ের গোলে তারা ২-১ গোলে হারিয়েছিল জামার্নিকে। নির্ধারিত সময় খেলা ১-১ গোলে ড্র ছিল।
অনূর্ধ্ব-২০ ও ১৭ নারী বিশ্বকাপ স্পেনের
কাতার বিশ্বকাপে ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন স্পেনের যাত্রা থেমে গিয়েছিল শেষ ষোলতে টাইব্রেকারে মরক্কোর কাছে হেরে। কিন্তু তার আগে ফিফা অনূর্ধ্ব-১৭ ও ২০ এই দুইটি নারী বিশ্বকাপই গিয়েছে স্পেনের ডেরায়। অনূর্ধ্ব-১৭ আসর বসেছিল ভারতে। ফাইনাল স্পেন ১-০ গোলে কলম্বিয়াকে পরাজিত করেছিল। কোস্টারিকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-২০ আসরের ফাইনালে জাপানের মেয়েদের ৩-১ গোলে ধরাশায়ী করে শিরোপা জিতেছিল স্পেন।
বিশ্ব ফুটবলে রাশিয়া নিষিদ্ধ
ইউক্রেনের উপর সামরিক হামলার কারণে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করে ফিফা। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ফুটবল সংস্থা উয়েফাও। দুইটি সংস্থাই যৌথভাবে বিবৃতি দিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা অনির্দিষ্টকালের জনন্য ঘোষণা করে। এর ফলে রাশিয়া কাতার বিশ্বকাপে প্লে অফ ম্যাচ খেলা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল পোল্যান্ড।এ ছাড়া, মেয়েদের ফুটবলে তাদের দল ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ। ক্লাব পর্বেও পড়ে এই যুদ্ধের প্রভাব। ইউরোপ লিগে তাদের ক্লাব স্পার্তাক মস্কো নকআউট পর্বে উঠে গিয়েছিল। প্রতিপক্ষ ছিল জামরানির লাইপজিগ। তারাও খেলতে পারেনি। এমনকি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের স্পন্সর ছিল রাশিয়ার গ্যাস কোম্পানি গাজপ্রম। তাদের সঙ্গেও চুক্তি বাতিল করে উয়েফা।
চেলসির ক্লাবের মালিকানা পরিবর্তন
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চেলসি ক্লাবের মালিকানাও পরিবর্তন হয়। ক্লাবটির মালিক ছিলেন রাশিয়ার ধনকুবের এবং রোমান আব্রামোভিচ। ২০০৩ সালে তিনি চেলসি ক্লাব কিনে নেওয়ার পরই ইউরো ফুটবলে শক্তিশাল দল হিসেবে আবিভূর্ত হয়। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে একাধিকবার।সেই আব্রামোভিচ ক্লাবটির মালিকানা বিক্রি করে দেন মার্কিন ব্যবসায়ী টোড বোহলির কাছে। অবশ্য তিনি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ ইংল্যান্ড ছিল ইউক্রেনের পক্ষে। ইংল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে চেলসি ক্লাবের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এরপরই আব্রামোভিচ ক্লাবটি বিক্রি করে দেন বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটিতে
এমপি/এমএমএ/